পৃথিবীর মজ্জা থেকে

মূল: কাহলিল জিবরানের ‘আউট অব আর্থ’

প্রচণ্ড র‌‌োষে ছিঁড়েখুঁড়ে পৃথিবীর মাঝ থেকে পৃথিবী বেরোয়;
আর গম্ভীর, সৌম্য ভীষণ, পৃথিবীর পর থেকে পৃথিবী হাঁটছে।
পৃথিবীর থেকে আরেক পৃথিবী, প্রাসাদ গড়ছে আর স্তম্ভ তোলে গগনস্পর্শী, সুরম্য মন্দির,
এবং পৃথিবী বোনে পৃথিবীর গাঁথা, বিশ্বাস ও আইন।

পৃথিবীকে ক্লান্ত করে তারপরে পৃথিবীর সব কাজ আর
তার স্বপ্নের, কামনার সুপ্রভ স্রোত।

এবং পৃথিবীর ঘুম পৃথিবীর চোখে করে ভর, সুস্থিত শান্তির মত।
আর পৃথিবীর ডাক পৃথিবীই শোনে:
“আমিই গর্ভ আর আমিই সমাধি আমার,
এমনই থাকবো আমি গর্ভ ও সমাধি
যতক্ষণ ধ্বংস না আসে অথবা সূর্য এই পুড়ে ছাই হয়।”

অপলাপ ০৩: 'বাঙলা' যেভাবে আমার দেশ হলো

দেশে জন্মালেই দেশ আপন হয় না। যতক্ষণ দেশকে না জানি, যতক্ষণ তাকে নিজের শক্তিতে জয় না করি, ততক্ষণ সে দেশ আপনার নয়। — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (দেশের কাজ, পল্লীপ্রকৃতি)

দেশ কীভাবে আমার আপন হলো এই কথা বলতে গেলেই বুঝি রবীন্দ্রনাথ আমাকে সাবধান করেন এই কথাগুলো বলে। আমি সন্দিহান, দেশকে আপন করার মত যথেষ্ট কাজ আমি করেছি কিনা। কিন্তু একথা স্বীকার্য, যেখানে কর্তব্যবুদ্ধি স্তিমিত, আইন যেখানকার নাগাল পায় না, যেখানে কোনো সংবিধান আমাকে দ্বিতীয়শ্রেণীর নাগরিকের পরিচয় দেয়নি, সেইখানে, আমার অবচেতন থেকে চেতনার উদ্ভাসে এদেশ আমার।

বাঙলা কীভাবে আমার দেশ হলো? হয়ত, আমার মায়ের মুখে শোনা যুদ্ধের গল্প থেকে শুরু। তখন আমার মায়ের কেবল শৈশব। সে গল্প বীরত্বের গল্প নয়। আমার মাতামহর তার পরিবারসহ এগ্রাম থেকে ওগ্রামে পালিয়ে ও লুকিয়ে ভারতে শরণার্থী হওয়ার গল্প। রজব আলী রাজাকার1 সেই গল্পে সশরীরে উপস্থিত না, অথচ তার ছায়া সদাই তাড়া করে ফিরেছে। সেইসব দিন, যখন মৃত্যু এবং জীবনের মাঝখানের রেখাটা বড্ড ক্ষীণ, যেখানে ক্ষুধার্ত শিশুরা আটা গোলানোর সাথে খাওয়ার জন্য কয়েকটি কাঁচামরিচের ঝোপ আবিষ্কার করে খুশি হয়, ঠিক সেইসব দিনেই বুঝি দেশ প্রথম আমার হলো।

  1. বাগেরহাট অঞ্চলের কুখ্যাত রাজাকার। 

আরো পড়ুন

পা

নিজের পায়ের শব্দে আঁতকে উঠি, ও কি আমার পা?
বুকের কাছেই জমজমাট অন্ধকার,
হাট বসেছে সেখানে‍,
আমি টিপ কিনি, তাঁতের শাড়িও।
একটু এগোলে স্টেশনের মাঝখান দিয়ে নদী
আর আমি এখন ট্রেনে তো তখন নৌকায় চড়ে বাড়ি ফিরি।
কম্পার্টেমেন্টে হেঁটে হেঁটে হঠাৎই নিজের পায়ের শব্দে কেঁপে উঠি!
ও কি আমার পা?
লেফট্ রাইট মার্চ ফরওয়ার্ড!
ও কি আমার পা?
দেখুন মশায়, ডানপন্থীরা ডান পা ফেলবে আগে…
ও কি আমার পা?
দেশের উন্নয়নে আমরা বদ্ধপরিকর, আমাদের পদযাত্রা অব্যাহত থাকবে…

অন্ধকারের ভেতরে একটা ট্যাংক গুঁড়িয়ে দিল সবকিছু।
মাথার ওপর কিছু উড়ে উড়ে পৃথিবী কাঁপিয়ে তোলে।
আমার পা দুটো বেসামাল
ছুটে যায় এদিক-ওদিক।
আমি অন্ধকারে যাবো।
আমাদের যৌথ আঁধারে।

আমাদের যৌথ আঁধারে আমরা তো ভালোই ছিলাম।
আমাদের নিজস্ব গান, শিশিরে ও নিয়ন সাইনে-
পদাবলী, প্রেম, সেইসব পুতুল খেলার দিন।
সেইসব ব্যথার বোধন,
একশো আটটি পদ্ম সেখানে, ব্যথাতুর, নীল।
কেবলই বুকের কাছে তোমার প্রতিমা,
আমিই স্তাবক ও পূজারি,
হাইকুর মত তুলির একটি টানে চক্ষুদান।
স্টেনগান, ক্ষুধা, ক্যাকাফনি, পৃথিবীর পচাগলা লাশেদের ভীড়ে,
আমি শুদ্ধচারী পুজোয় বসেছি।

আমি সেখানেই যেতে চাই,
ট্রেনে-বাসে ঝুলে,
নৌকোয় গাদাগাদি,
সাঁতরে বা ডুবে-
আমি সেখানেই যেতে চাই।
তবু আমার পা দিকবিদিক ছুটতে থাকে।
খচমচে চামড়ার জুতো।
ও কি আমার পা?
হাজার মানুষ চলে, বিস্মৃত, নির্জীব, সেই পথে দুড়দাড় হাঁটে…
ও কি আমার পা?
সভ্যতার ফসিলে আমার পা আটকে যাচ্ছে স্থবির,
রগ ও পেশি ব্যথায় টনটন করে।
মানুষের পায়ে পায়ে আমি পা মেলাতে পারি না।
প্রলাপের মত এলোমেলো পদক্ষেপে
কেবল হুমড়ি খেয়ে পড়ি।
চেয়ে দেখি ওই আমার পা নয়,
এমনকি আপাদমস্তক আমার কিছুই আমার নেই।

রাগ

আজকাল আমার ভীষণ রাগ হয়।
বস্তুতঃ রাগ ছাড়া আর
কিছুই এখন আমার হয় না।
মনে করো ছুঁলে,
আমার তো গলে যাওয়ার কথা স্পর্শ পেলেই!
চুমুর ধারাপাতের ভুল উত্তর হবে শুধু।
কন্ঠে জড়িয়ে থেকে বোষ্টুমির কন্ঠী যেমন
গিরিখাদ বেয়ে ক্রমশ ভাটির দেশে আসা-
তেমনই কথা ছিল।
অথচ, আমার শুধু রাগ হয়।
আমি কেবলই জ্বলে উঠি,
কেবলই উথাল-পাথাল,
কেবলই ঝড়ের তানে বেদনার সঙ্গত শুনি।
আমার ভীষণ রাগ হয়।
যারা আসে চলে গিয়ে আরো বেশি করে থেকে যেতে,
তাদের ওপর,
আমার ভীষণ রাগ হয়।

সরোদ

আমি সেই প্রগাঢ় নির্জনতা ছুঁয়ে
একাকী নিদাঘে পুড়ে খাক,
একা একা বেজে গেছি সরোদের মত
শতগ্রন্থী সুরে।
বেদনা অমোঘ নয়, তার কোনো চেনা সুর নেই।
সে কেবল ছুঁয়ে ছুঁয়ে রঙ বদলায়,
বুকের উঠোনে লুটোপুটি, সাঁতরায়, ডাক দেয়।
কোথায়? কে জানে!
মজ্জার ভেতরে ব্যথা চুঁয়ে চুঁয়ে
রক্তের ভেতরে মেশে মৃগনাভি স্বেদ।
নিষ্কৃতি নেই।
আমি খুব অগোছালো বেজে যাই বোকার মতন।
টুঙটাঙ অনুনাদ বুকে,
কুমারী ভোরের কাছে
চুপিচুপি
পরিচিত বেদনা জানাই বারেবার।
সে প্রবল ক্ষুধা বয়ে মাথার ভেতর,
চোখের ভেতর গেঁথে উজ্জল আলো
ঘুমতে পারি না আমি।
আমি জাগি, আমি বাজি শতগ্রন্থী সুরে।