দূর

তুমি আমার যোজন যোজন দূর
মাঝখানে এই নীরবতার স্তব্ধ সমুদ্দুর।
কথার নৌকা ডুবলো কবে ঝড়ে
নিভলো আলো তোমার বাতিঘরে।
বুকের কাছে জমটি অন্ধকার
পুব-জানালায় তারার হাহাকার।
ঘাসের পরে শিউলি ফুলের ঝাঁক
ডাক পাঠায় কি? পাঠায় না সে ডাক।

তুমি আমার যোজন যোজন দূর
মাঝখানে এক অন্ধকারের রাত।
মাঝখানে এক নিকষ বিভীষিকা
কেমন ভীষণ, আকাশছোঁয়া দেয়াল।
তুমি আমার বুকের কাছেই ছিলে
কেমন করে এতো দূরে এলে?

আমি এখন যোজন যোজন দূর
মাঝখানে এক ব্যথার সমুদ্দুর।
তবু তোমার কথার নাবিক এলে
বাতিঘরের আলোটা দাও জ্বেলে।
দখিনদিকের জানলাটা থাক খোলা
ভালোবাসা বুকের কাছে তোলা।
ভোরবেলাটায় শিউলি-স্মৃতির বনে
যদিও যাও, পা ফেলো সাবধানে।

নাক্ষত্রিক

আমরা নক্ষত্রজাত – কার্ল সেগান1

সে এক নক্ষত্র ছিল।
কবে কোন ছায়াপথ থেকে চুপে চুপে পালিয়ে এসেছে।
শ্রমণবৃত্তি তার, আলোকবর্ষব্যাপী কত হেঁটে চলা।
কত তারা হারিয়ে গিয়েছে
আত্মমগ্নতায় নিজের ভিতরে
ক্রমাগত লীন হয়ে, ফাঁপা হয়ে।
কত কৃষ্ণগহ্বর হিলিয়াম মেঘ ভালোবেসে
কোয়েজার2 হয়ে গেলো জ্বলে।
তবু তার ছুটে চলা, স্তিমিত, ধীর।

আমাদের সাথে তার হয়েছিল দেখা?
আমাদের ব্যথা, সুখ, সংঘাত আর ভালোবাসা-
আমাদের গভীর বিষাদ-
সেও কি নক্ষত্রজাত? আমাদেরই মত?
আমাদের প্রেম ও পিপাসা,
মজ্জার গভীরে শুধু ছুটে চলা, পালিয়ে বেড়ানো?

একপ্রস্থ অন্ধকার শরীরে জড়িয়ে
তোমার দুয়ারে আমি।
সহস্র আলোকবর্ষ
আর এক মহাকাল যাত্রার ক্লান্তি আমার।
আমায় স্পর্শ করো
পেঁজা পেঁজা মেঘের মতন।
আমাকে জ্বালিয়ে দাও, জ্বলে যাও
নাক্ষত্রিক প্রেমে।

  1. “We are made of starstuff.” Ref. 

  2. কোয়েজার বা quasar একধরনের কৃষ্ণগহ্বর যার প্রবল অভিকর্ষের প্রভাবে বস্তুসমূহ যখন পতিত হয় তখন প্রচুর বিকিরণ ঘটায়। এদের খুব উজ্জ্বল দেখায়। 

রাগ এবং বিবিধ খুনসুটি

তোমার ভীষণ রাগ হলো, জানলা বন্ধ হলো সশব্দে।
আমার ভীষণ রাগ হলো
অন্ধকারে হাতড়ে দেয়াশলাই পেলাম টেবিলের পরে-
ছুঁড়ে ফেললাম।
রেগে গিয়ে লোডশেডিঙের ভ্যাপসা গরমে
কাঁথা মুড়ি দিলে।
রেগে গিয়ে ব্যালকনিতে সিগারেট ধরালাম, যেন খুব প্রতিশোধ।
তোমার ভীষণ পরাজিত বোধ হলো।
আমার ভীষণ হারিয়ে ফেলার দীর্ঘশ্বাস।
যখন কাঁথাটা খামচে নিজের ভেতর কুঁকড়ে যাচ্ছ
আমার তখন পরাজিত বোধ হলো।

হাতড়ে দেয়াশলাই, জ্বালালেম মোম।
বিছানায় ফিসফিসিয়ে কবিতা,
গোপনে, কানের কাছে।
কতটা যে অভিমান ফুঁপিয়ে উঠলো!
তোমার। ঠোঁটের কাছে।

বুকের ওপর কিল পড়লো সশব্দে-
আর মৃদঙ্গ বাজলো কোথাও!
চোখের কোণায় জল আসলো,
আর একটা নদীর কল্লোল শোনা গেলো।
মানুষের বুকের শব্দ শোনা গেলো।
কোথাও একটা আর্তি শোনা গেলো।
তোমার? আমার?

ভীষণ যুদ্ধ শুরু হলো!
কপালে ঠোঁট রাখতেই… “না”!
কন্ঠে… “না”!
: আর হবে না, সত্যি!
: মেরে ফেলবো তোমায়!
: সত্যি হবে না!
: সিগারেট খেলে কেন? বাজে!
: আর করবো না, ব্রাশ করে আসি?
তুমি কলার ধরলে টেনে
ঠোঁটে ঠোঁট রাখলে যখন
আমার তখন বলা হলো না কিছুই।
মোমবাতি পুড়তে পুড়তে নিভে গিয়ে
যখন আকাঙ্খিত অন্ধকার আনলো
ততক্ষণে রাগ গলে জল।
আমাদের দৃষ্টিসীমায় কোনো কূল নেই বলে
আমরা পরস্পর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ডুবতে থাকলাম।
তোমার ভীষণ মায়া হলো,
আমার আদর।

পুতুলনাচের ইতিকথা: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

পুতুলনাচের ইতিকথা এতদিন বইটা না পড়া রীতিমত একটা অপরাধ। সত্যিকারের কালজয়ী লেখা বলতে যা বোঝায় এ হলো তাই।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রগুলো সাদামাটাভাবে শুরু হয়। তাদের আচরণ, গন্তব্য সব সাদামাটা। দরিদ্র আদর্শ দরিদ্র, জোতদার ছেচড়া জোতদার, গ্রাম্য ডাক্তার যথার্থ গ্রাম্য ডাক্তারের মতই ফিসের তাগাদা দেয়। এবং, শেষমেশ তাদের নিয়তিও এমনকিছু আশ্চর্যজনক না। আশ্চর্যের ব্যাপার তাদের হঠাৎ কোনো ব্যবহার, কোনো কথা, কোনো হাসি। ‘শেষের কবিতা’য় রবীন্দ্রনাথ লাবণ্যের প্রথম পরিচয় যেমন পাহাড়ের পটভূমিতে বিদ্যুতঝলকের মত দেখিয়েছিলেন, চরিত্রগুলো তেমন কোনো ঝলকে ঝলকে বোধি দেয়, জানিয়ে দেয় যে মানুষের ভেতরে আরো কোনো মানুষ থাকে যে তার গড় মানবিকতার উর্ধ্বে। মানুষ তারা, এমন মানুষকে বিশ্বাস করতে ভালোলাগে, ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। …

আরো পড়ুন

আমি

আমি এমন ক্ষুদ্র মানুষ,
আমি এমন ব্যর্থ মানুষ-
আমার শত কাতরতা
বিস্মৃত আর প্রাক-পুরাণিক এখন যেন।

আমি এমন দীর্ঘ মানুষ
বৃষ্টিবনের ঝাপসা আকাশ
মাথার থেকে অনেক নীচে।
আমি এমন ক্ষুদ্র মানুষ
কখন হলেম চোখে আড়াল
কেউ জানেনা।

নিঃস্ব মানুষ,
ভিতর-বাহির নিঃস্ব ভীষণ
বিপথ যাওয়া ভ্রষ্ট মানুষ।
আমি ভীষণ কষ্টে পোড়া মানবেতর।
আমি ভীষণ নষ্টে ভোগা যন্ত্রমানুষ।
আমি ভীষণ আঁকড়ে ধরা,
আঁকড়ে থাকা বেভুল মানুষ,শস্তা মানুষ।