অপলাপ ০১: আমার শহর

পৃথিবীর আর দশটা দেশের মাপকাঠিতে যাকে শহর বলা চলে খুলনা বোধহয় তা না। বিভাগীয় এই শহরটিকে মফস্বল বললে খুব একটা মানহানি হয় না তার। এর গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে দূরত্ব সময়ের হিসেবে ঘন্টা পেরোয় না।

আমি এই শহরে জন্মেছি ও বেড়ে উঠেছি। শহরটা আমার মজ্জাগত, আমার নাগরিকতা এই শহরের ছাঁচে ঢালা। ব্রিটিশ ভারতে কোলকাতার ‘ভদ্র’ বাবু এবং দুষ্টু সাহেবরা আসতেন ভৈরবের তীরে বড়বাজার সংলগ্ন এলাকায়, দেহপসারিণীদের কাছে। বাবু সমাজে একজন-দুজন রক্ষিতা রাখা নৈমিত্তিক হলেও একটা জাত ছিল শুনেছি যারা এটা রাখতে লজ্জা পেতেন। তাই এই গ্রাম্য নগরে তাদের পদধূলি পড়ত। সেই থেকে বড়বাজারের পত্তন, শহরের প্রসার। সে আমার যুগ না। আমি জন্মেছি বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষ সীমান্তে। পৃথিবীর প্রবল ঘুর্ণনে ছিটকে পড়েছি একবিংশের গোড়ায়। আমার চেতনায় বিংশ আছে ছায়া হয়ে, একবিংশ ভাস্বর। …

আরো পড়ুন

তুমি নেই

সূর্য অথবা চাঁদ এবং নাক্ষত্রিক সামগান নেই।
আলো বা অন্ধকার,
প্রবল ঔজ্জল্য থেকে নিকষ সুপ্তি, নেই।
স্রোত নেই, বুকের ভেতর নেই ধরে রাখা সমুদ্রনিনাদ।
সুগভীর ঘুম থেকে বুক ধড়ফড় জেগে ওঠা
অথবা নিদ্রাহীন রাত নেই।
প্রবল কামনা নেই, স্থিতধী প্রাজ্ঞ বোধি নেই।
সে এক অস্থিরতা, সে এক ঝড়ের মত
আমি তার সবটা জানিনা, বুঝিনা কিছুই-
স্বত্তাজুড়ে অবিমিশ্র শুধু ‘নেই’,
তুমি নেই
তুমি নেই
তুমি নেই…

প্রদোষ

প্রদোষে পথের কাছে যাই।
পথের তো লন্ঠন নেই,
তার আছে দীপাবলি-
জ্বেলে বসে থাকে।
প্রদোষে পথের কাছে যাই
আমাদের সখ্য ভীষণ।

আটপৌরে অন্ধকার সদাগরি হিসেবের মত
আমার সে জানা আছে।
আমার কী জানা আছে সবটাই তার?
উত্তাপ, হিম।
প্রদোষে পথের কাছে যাই
কুয়াশায় জুবুথুবু ল্যাম্পপোস্ট-পাশে
যদি থাকে দাঁড়িয়ে আঁধার?

সে এক নগণ্য কবি
যার বোধি ডুবে গেছে শীতের প্রদোষে।
আঙুলের ফাঁক গলে চেতনার গভীর নিনাদ
স্থিত সুর, মধুর খেয়াল পড়ে যায়।
মসলিন বুনটে আবেগ
কোথাও কি ধরা পড়ে? আঙুল জানেনা।
প্রদোষে পথের কাছে যাই অন্ধকারে।
ধৃতরাষ্ট্রের মত-
কখনো যে দেখে নাই
নিজভূমে স্বর্ণাভ ফসলের রঙ।

ছুটি

উপকূলের গেওয়া গাছ শীতের ছুটিতে সটান দাঁড়িয়ে।
মনসা-বটের গৃহী সাপটাও
কোটরে কোথায় ছুটিতে লুকোলো।
পরিযায়ী পাখিদের ঝাঁক
আরেক গোলার্ধ থেকে এলো ভ্যাকেশনে।
কখন তোমার ছুটি?

জোনাকির ছুটি হয় সারারাত নক্ষত্র জ্বেলে।
টুনাটুনি পিঠে করে-
বাঘমামা নিমন্ত্রণে যায়।
চাতক-যাচিত ছুটি মিলে যায় আষাঢ়ের দিনে।
মেঘেরা ছুটিতে যায়,
জুবুথুবু সূর্য শীতের-
আকাশে ছড়াতে থাকে নির্মোহ রোদ।
কখন তোমার ছুটি?

বছরগুলোর ছুটি মেলে।
বয়সের খাতা ভারি হয়-
আমার দেউলেপনা ক্রমে বাড়ে বয়সের সাথে।
বৈরাগ্য-মেদুর দিনে
জ্বেলে বসি কামনার হোম-
ভালোবেসে।
তোমার কখন ছুটি? কখন সময় হবে?

বালিকা জানো কি?
খুব গাঢ় ছুঁয়ে দিলে বুকের শিশির
আমাদের মিলে যাবে কামনার বোধি।