অপলাপ ০৩: 'বাঙলা' যেভাবে আমার দেশ হলো
দেশে জন্মালেই দেশ আপন হয় না। যতক্ষণ দেশকে না জানি, যতক্ষণ তাকে নিজের শক্তিতে জয় না করি, ততক্ষণ সে দেশ আপনার নয়। — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (দেশের কাজ, পল্লীপ্রকৃতি)
দেশ কীভাবে আমার আপন হলো এই কথা বলতে গেলেই বুঝি রবীন্দ্রনাথ আমাকে সাবধান করেন এই কথাগুলো বলে। আমি সন্দিহান, দেশকে আপন করার মত যথেষ্ট কাজ আমি করেছি কিনা। কিন্তু একথা স্বীকার্য, যেখানে কর্তব্যবুদ্ধি স্তিমিত, আইন যেখানকার নাগাল পায় না, যেখানে কোনো সংবিধান আমাকে দ্বিতীয়শ্রেণীর নাগরিকের পরিচয় দেয়নি, সেইখানে, আমার অবচেতন থেকে চেতনার উদ্ভাসে এদেশ আমার।
বাঙলা কীভাবে আমার দেশ হলো? হয়ত, আমার মায়ের মুখে শোনা যুদ্ধের গল্প থেকে শুরু। তখন আমার মায়ের কেবল শৈশব। সে গল্প বীরত্বের গল্প নয়। আমার মাতামহর তার পরিবারসহ এগ্রাম থেকে ওগ্রামে পালিয়ে ও লুকিয়ে ভারতে শরণার্থী হওয়ার গল্প। রজব আলী রাজাকার1 সেই গল্পে সশরীরে উপস্থিত না, অথচ তার ছায়া সদাই তাড়া করে ফিরেছে। সেইসব দিন, যখন মৃত্যু এবং জীবনের মাঝখানের রেখাটা বড্ড ক্ষীণ, যেখানে ক্ষুধার্ত শিশুরা আটা গোলানোর সাথে খাওয়ার জন্য কয়েকটি কাঁচামরিচের ঝোপ আবিষ্কার করে খুশি হয়, ঠিক সেইসব দিনেই বুঝি দেশ প্রথম আমার হলো।
আমি জাতীয়তাবাদী (Nationalist) নই, জাতি-সচেতন (Nation-aware)। আমি, আমার বাইরে কিছু মানুষ, তারপর পাড়া, তারপর শহর বা গ্রাম, জেলা (অধিকাংশ মানুষের জেলাকেন্দ্রিক একটা জাতীয়তাবাদ দেখি। “অমুক জেলার পোলা, আশি টাকা তোলা” গোত্রীয়।) তারপর একটা দেশ… ব্যস! আমার সার্বজনীনতা এতটুকুতে থেমে যাবে না। তবে আমি আমার শেকড় বহন করবো। সে শেকড় প্রাণহীন হোক, তবুও। মহাবিশ্বের সামনে বিস্মিত আমি যখন দাঁড়াবো তখন আমার ভালো-মন্দ সবকিছু নিয়েই দাঁড়াবো। আমি কি আমার দেশ, আমার জাতি সমস্তকিছু নিয়েই আমি নই? বস্তুতঃ দেশ শুধু আমার নয়, আমিও এই দেশের। সমস্তকিছু নিয়েই প্রচণ্ড বেগে অন্তরীক্ষে আমি ছুটে চলি, উদ্দেশ্যহীন।
যতদিনে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, ইতিহাসের বইগুলো আমাকে বোকা বানানোর মত যথেষ্ট শক্তিশালী হতে পারেনি। আমি বিশ্বাস করি না ফরায়েজী আন্দোলন বা সিপাহী বিদ্রোহ দেশের জন্য ছিল। তার আগেরগুলোর তো প্রশ্নই নেই। হ্যাঁ, এগুলো ইংরেজবিরোধী ছিল, তবে স্বদেশী না। স্বদেশের ধারণাটাই তখন ছিল কিনা সন্দেহ। বস্তুতঃ রাজায় রাজায় বা রাজার সাথে মতাদর্শের যুদ্ধ সেগুলো, মানুষের জন্য গণতান্ত্রিক দেশের জন্য যুদ্ধ সেসব নয়। স্বদেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য দ্রোহ আরো পরে এসেছে। একইভাবে ফজলুল হক বা সোহরাওয়ার্দীকে আমি মহান নেতা মানতে নারাজ, যেমনটা আমরা বিদ্যালয়পাঠ্য ইতিহাস বইতে পড়েছি। বাঙলা আমার দেশ ও ভাষা হলো একুশের আত্মদানে, সূর্যসেনের দ্রোহে, মাথার ভেতর বারুদ নিয়ে ঘোরা সেইসব একাত্তরের শহীদদের রক্তে, যাঁরা বেঁচে থাকলে পাথরেও ফুল ফোটাতে পারতেন ভালোবাসায়। কী ইস্পাতদৃঢ় তাদের সংকল্প, আমার ঈর্ষা হয়।
দেশ আমার আপন হয় রবীন্দ্রনাথ ও লালনে, রুদ্রে ও শামসুর রাহমানে, সুনীলের অনুবাদে গিন্সবার্গের কবিতায়, হ্যারিসনের আর্তিতে, জহির রায়হানের ছায়াছবিতে, সলীল চৌধুরী এবং হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গণসঙ্গীতে।
শৈশব-কৈশোর এভাবে কেটে যায়, আস্তে আস্তে হতাশা আসে, প্রিয় প্রিয় মানুষগুলো খুন হয়ে যায়, মাঝেমধ্যে মনে হয় আমাকে বলা হচ্ছে, “এদেশ তোমার নয়”। অথচ, আমি বহু ভোরে নদীর ওপর সূর্যদয় দেখেছি, সোডিয়ামের হলুদাভ আলোয় রাস্তায়, বস্তিতে ক্ষুধা দেখেছি, সরল কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের ভেতর থেকে আর্তি দেখেছি, ভাষাহীন, মূক। আমার তখনই মনে হয়েছে, এদেশ আমার, এই মানুষেরা যারা জন্তুর চেয়ে বেশি করে বাঁচতে আজও শেখেনি, এ আমার মানুষ।
বস্তুতঃ আমাদের সংগ্রাম আরও কঠিন। বহুবিধ ভোগের কুয়াশা আমাদের বিচারবুদ্ধিকে স্তিমিত রাখে। আমাদের ব্যক্তিস্বার্থ জাতীয় স্বার্থের পথে অন্তরায় হয়। আমাদের এই ক্লীবতা জাতিকে করে উদ্যমহীন। তবু ডাক পেলে দাঁড়িয়েছি, শাহাবাগ থেকে শিববাড়ি আমারও ঘরবাড়ি2 ছিল অনেকদিন। তবু এই উচ্ছাস, এই চিৎকারই একমাত্র সত্য নয়। আরো বড় হীনতা আমাদের ক্রমাগত নিষ্পেষিত করছে অথচ আমরা বুঝতে পারছি না। অশিক্ষা এবং শিক্ষার নামে কুশিক্ষায় আমরা ক্রমে আরো হীনবল হচ্ছি। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ দ্বায়ভার নিতে আমরা অপারগ। এজন্যই অর্ধশতকে না পৌঁছতেই আমরা শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছি। কী পাহাড়ে কী সমতলে, যে দুর্বল তার ওপর ব্যক্তিস্বার্থ রাজশক্তির রূপ নিয়ে প্রবলতর নিপীড়ন চালাচ্ছে। মূর্খের স্বাধীনতা বা গণতন্ত্র কোনোটাই মানায় না।
আমি জানিনা কীভাবে উত্তরণ ঘটবে। তবে এইটুকু বেশ বুঝি, সুশিক্ষা ছাড়া তা কোনোভাবেই সম্ভব না। আমাদের খোল-নলচে ফেলতে হবে একেবারেই বদলে। পুরাতন আদর্শ ও বিশ্বাস সব নিতে হবে যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা যা সৃষ্টিশীলতার উদ্বোধন ঘটায় তা ছাড়া এমনটা সম্ভব নয়। যখন তা পারবো, যখন আমাদের ব্যক্তি আমিকে ছাড়িয়ে মহাবিশ্বের সামনে নিজেকে তুলে ধরতে পারবো তখনই আমাদের দেশ হবে দেশের চেয়েও বড়। যতদিন সাম্য আসছে না আমাদের বোধে, আমাদের হৃদয়ে- ততদিন কোনো আইনে, কোনো বহিরঙ্গের কাঠামোতেই সাম্য আসবে না। সারা পৃথিবীও একই রোগে আক্রান্ত। আমি আশাবাদী হতে পছন্দ করি এই ভেবে, কে জানে মহাদৈন্যের পাকুড়ের অন্ধকার ছায়ায় পাওয়া সাম্যের বোধি হয়ত আমরাই দেবো পৃথিবীকে!
জাতির রক্তে ফের অনাবিল মমতা আসুক
জাতির রক্তে ফের সুকঠোর সততা আসুক
আসুক জাতির প্রাণে সমতার সঠিক বাসনা ।। — রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (হাড়ের ঘরখানি)
‘অপলাপ’ সংকলনের লেখামাত্রই অপলাপ নয়। জ্ঞানত অপলাপে আমার রুচি নেই। শুধু এই কথাটাই বলতে চাই যে আমার সত্য স্বাভাবিকভাবেই আমার দেখার রঙে রাঙানো। তা আমার কাছে যৌক্তিক। সে সত্য সার্বজনীন সত্যের মাপকাঠিতে মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে। এ তো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নয়, এ হলো আমার স্মৃতি যা সবসময়ই দুর্বল। সে দুর্বলতার ফাঁকগুলো আবেগের রঙ দিয়ে নিজের অজ্ঞাতেই পূরণ করতে পারি।