বসন্ত

এক বসন্ত মেঘের ছায়ায় শীতল আমার।
এক বসন্তে কালবোশেখির গান শুনেছি।
এক বসন্ত অকাল বাদল হয়েই ঝরে,
এক বসন্ত অন্ধকারের গভীরে ডুব।
আর বসন্তে তোমার প্রথম পেলাম দেখা।

আমিই তোমার হাত ধরেছি?
ভুল বলেছি? তুমিই প্রথম হৃদয় ছুঁলে?
শীতল মেঘে জ্বললো প্রদীপ সূর্য নামে।
কালবোশেখির বক্ষে তুমি সুর জাগালে।
অকাল বাদল ফুল ফোটলো যত্রতত্র পথের পাশে।
অন্ধকারের চাদর জুড়ে নকশা আলোর।
সেই বসন্তে আমিই হলাম নতজানু।
আবারও ভুল? যেচেই হলে ভিক্ষা আমার।

সেই বসন্ত আবার এখন আসছে ফিরে।
বর্ষা এবং শীতের শেষে
এই বসন্তে তোমার পাবো দেখা আবার।

অক্রীতদাসের ভাষ্য

এক

এখনো ঘোরের মত চোখে কেন তুই লেগে থাকা?
আমার ঘুমের সাথে তোর কেন এমন বিরোধ?
অনেক রোদের তাপে ঝলসাতে আমার দুচোখ
অদৃশ্য সূর্যের মত রাতজুড়ে তোর থাকে ছায়া।

দুই

অভিমান তীব্র হলে পরে
আমার ঘামের ঘ্রাণ সুপুরুষ হয়।
আমার এ দেহ ছুঁয়ে, গিয়েছে যে বিগত সময়-
অতৃপ্তির শ্লেষ রাখে ওষ্ঠে-অধরে।

প্রিয় প্রিয় অনুভূতি বলিকাঠে চড়ালে, নিকষ
আধাঁরের বুক চিরে ভেসে যায় নির্মোহ রক্তের স্রোত,
তবুও মোহের ঘোরে আমার এ শরীর বিবশ
অনেক ঋণের ভারে ঋণী যেন ক্রীতদাস তোর।

তিন

আর তোর চোখ ছুঁয়ে
ফুরনোর পথে গেলে কিশোরী বিকেল-
আমার পায়ের নীচে
ঝরা পাতা কেঁদেছে নিবিড়।
আমার শোণিত-স্রোতে
যতোটুকু বয়ে চলি আরোপিত প্রেম,
যতোটুকু ভাসে অবয়ব
যতোটুকু পাওয়া যায় তার রূপরেখা
তাতেই অতৃপ্তি বাড়ে
দারুণ লোভীর মত
আমি শুধু খুঁজি ভালোবাসা।

চার

আর তোর ক্ষতজুড়ে ছোঁয়ালে আঙ্গুল আর ঠোঁট,
ছোঁয়াচে প্রেমের ঘোরে ফিকে হবে নিবেদিত রাত।
আর তোর হৃদয়ের দোরে, করাঘাতে আর্তি জানালে
শিউলি ফুলের মত, ঝরে যাবে নমনীয় স্বেদ।
বুকভরে ঘ্রাণ নিয়ে আমি যদি গভীরে হারাই
আমি যদি চেনা সব দেহ-রঙ-ব্রাশের আঁচড়
ভুলে হই নতজানু, অধিকৃত দেহটির স্বাদে
তোর কি তৃপ্তির কিছু খুব বেশি হবে হেরফের?

পাঁচ

আমাকে মাটির টানে আটকাতে কেন এত শখ?
আমিতো বানের জলে কবে গেছি ভেসে।
সময়ের স্রোতে আমি ভাসি মৃতবেশে
আমার শরীর-মনে শ্যাওলার সিক্ত বসতি।
আমার রক্ত থেকে কেন মুছে যাচ্ছে না তোর সুঘ্রাণ?
ফুসফুস পেলে নিকোটিন, আমার হৃদয় কেন তৃষ্ণার্ত থাকে?
আমার ওষ্ঠ কেন ভুলে যায় সহজিয়া প্রেমের বয়ান?
কেন আমি ভালোবেসে তীব্র আবেগে
ধুয়ে মুছে তুলে রাখি ভঙ্গুর কাঁচের পৃথিবী?

স্টেশন

স্টেশন থেকে রেলের স্লিপার গুনে গুনে,
কিছুটা পথ পেরোই যদি, শহরটা খুব অচেনা হয়৷
অচেনা কেউ অনেক আপন হয়ও বুঝি?
তারও কাছে বাতাস-ধূলোর ঋণ থেকে যায়?
টেলিগ্রাফের তারে কারোর মনের খবর,
কেউ চাদরে মাখছে কারো হাতের আদর,
কারো কাছে ল্যাগেজ বোঝাই স্বপ্ন আছে,
কারো ঠোঁটের স্পষ্টকথার লিপস্টিকে
অন্য কারোর নিকোটিনের তৃষ্ণা ফুরোয়।
তবুও কেউ রেলের স্লিপার গুনে গুনে
শহর ছেড়ে অনেক দূরের পথ নিয়েছে।

অপরাধ

যে শিশুটি মাতৃগর্ভেই গুলিবিদ্ধ হয়েছিল বলে পৃথিবীর আলো আর যার দেখা হয়নি…

এমন আকাশ আমি কোথাও দেখিনি।
এমন রৌদ্রজ্জল দিনে নির্লিপ্ত রোদের হাহাকার-
এমন বাতাস এই হেমন্তের দিনে
দেখিনি কখনো।
কংক্রিটের বুক ফুঁড়ে বেরিয়েছে
ব্যালকনি-কার্নিশে নিদাঘ বেদনা।

প্রতিটি শিশুর কাছে প্রতিটি কবির
যতটুকু অপরাধ আছে
তার শত নিষ্ক্রিয়তায়,
প্রতিটি ভ্রুণের কাছে প্রতিটি মানুষ
যতটুকু ঋণী-
তা শোধ নাহলে ধ্বংসের ব্যত্যয় কই?
এ অলীক সভ্যতায় গর্ভপাতের ব্যথা নিয়ে
এত নীল এই আকাশের মত
আমি আর কোথাও দেখিনি।

কার কাছে ক্ষমা চাই বলো?
একফালি মাংসপিন্ড
মানুষের অবয়ব পেয়েছে কেবল।
আহা! ঘুম ছিল,
অন্ধকারের ওমে
নাড়ি থেকে রক্ত-মাংস-মজ্জায়
চুম ছিলো
প্রগাঢ় মমতার।

তোমার পৃথিবী
ভেঙেচুরে যায় যেই
গড়ে উঠবার ঠিক আগে।
আর আমি বেঁচে থাকি-
আমরা বেঁচেছি, সব বেঁচে আছি
মাথা হেঁট করে আর
নিজের বৃত্তে ঘুরে সুবিধামতন-
সেই অপরাধে
কী ক্ষমা চাইবো বলো?
এত ঘৃণা নিজের প্রতিই
প্রগলভ ক্ষমাভিক্ষায় তার হয়না স্খলন।

পালানোর কবিতা

এই কবিতাটা হতাশার নয়। বুঝলেন?
পেলব জ্যোৎস্না-স্নাত শিশিরের স্বেদ-
তার ঘ্রাণ, এখনো উবতে বাকি
এই কবিতার দেহ থেকে।
এই কবিতাটা মৃত্যুর নয়।

আমি বেশ অগোছালো পিতা কবিতার।
কবিতাটা বাধ্য ভীষণ।
যখন কোথাও আগুন লাগছে দেখে
সে কিন্তু পাশ কাটিয়েই চলে!
পোড়া মানুষের দিকে তাকানোর অবসরে
নীল শাড়িটার ভাঁজ ঠিকঠাক,
কপালে কমলা টিপ
ঠিক মাঝখানে বসে যায়।

গুনে দেখি, তিপ্পান্নটা লাশ।
সংখ্যাটা খুব কম।
তিপ্পান্নজন মানুষ।
আমি চিনি না তাদের।
তিপ্পান্ন একটা সংখ্যামাত্র।
আমার কিচ্ছু এসে যাচ্ছে না।

এই কবিতাটা স্বার্থপরতারই।
এই কবিতাটা ভালোবাসার না।
চামড়ায় কামনা-পারফিউম মেখে
এই কবিতাটা
তার নোংরা ত্বকের আবরণে
ঢেকে রাখে নিস্পৃহ সাপ।

এই কবিতাটা পালানোর।
আগত যুদ্ধ ছেড়ে,
বেশ্যাবাড়ির মোড়ে দাঁড়ানোর কবিতাটা এই!