ঘাটের কথা

আমার একটা পাথুরে জনম কেটে গেছে।
বয়েই গেছে সে ছলছল
মাদকতা মাখা সুরে বিহ্বল
ছুঁয়ে গেছে।

আমার একটা পাথুরে জনম স্থবির অটল
প্রেয়সীর স্বেদে শ্যাওলা স্মৃতির
ইন্ধনে রোজ
নির্ঘুম রাত
বজরার আলো
পানসির দেহ বুকে নিয়ে তার
আলোর দেয়ালী দেখে দেখে।

আমার একটা পাথুরে জনম
কেটে গেছে ধ্যানী।
বুকের ওপর চুম্বন তার
রোদের আখরে
রূপোলি সময় এঁকে দিয়ে গেছে।

আমার একটা পাথুরে জনম কাটিয়ে দিয়েছি
আরো সহস্র পাথুরে জনম
প্রেয়সীর বুকে নোনা বাড়ে রোজ
রূপ ঘোলা হয়
বাঁকে মেদ জমে
তবুও ভিতরে নদী ছিল তার নদী আছে।
তবুও সে তার বহমান দেহ বয়ে নিতে নিতে
নগণ্য এক ঘাট মনে রাখে, ভালোবাসে।

পূর্বরাগ

কারচুপিতে বুকের কাছে সুক্ষ্ম সেলাই
দেয়না ধরা তোমার চোখে।
ভুল করে খুব ছোঁওবা যদি
পাঁজর গড়া জাইলোফোনে
মন্দ্রাক্রান্ত সুর তুলে যাও।
আকাশছোঁয়া অফিসবাড়ির
চুড়োয় কিছু নীল জমছে
ষড়যন্ত্রী বুকের পশম
তাঁদের রঙে রঙ মিলিয়ে
তোমায় কিছু বলবে বুঝি?

বসন্তে যে তুমি আমার ঠোঁট ছুঁয়েছো,
আমার শরীর নিঙড়ে দিয়ে
জল জমেছে তোমার বুকে
বৈশাখে তার সবটুকু কি গেছে উবে?
শ্রাবণে তার একটুও কি হয়নি জমা?
কুয়াশা আর হিমের ঘোরে ঋদ্ধ হলে
তোমার বুকের জলতরঙ্গ
অনেকখানি সংবেদী হয়।
শ্রুতির সীমা পেরিয়ে কোথাও বাজবে কি তার?
স্টেশন বাজার পেরিয়ে যখন সন্ধ্যা নামে
তোমার ঘরের ব্যালকনিতে অবাধ্য রোদ
বাধ্য ভীষণ, লজ্জিত আর ক্রিমসন রেড।
আমি তখন অন্ধকারে ডুবতে থাকি
হৃদপিন্ডে অসহ্য এক শীতলতা,
আমার তখন তোমার দেহের ওম প্রয়োজন।
আমি এমন অন্ধকারে কুল পাবো কি?
পাবো আবার অধর ছোঁয়ার অনুমতি?

অভিমানী পঙ্কতিমালা

ঘুমপালানো মেঘের দলে
রামধনুকের সাতটা আঁচল
মেলে দিতেই
আমার চোখে শ্রাবণ আসে?
তোমার চোখে কালবোশেখি
কাজল কোনো?

প্রদীপখানি জ্বালতে গেলেই
দমকা হাওয়া নিবিয়ে দেবে
সেই ভয়ে কি তোমার আঁচল
সলতে হল?
বুকের কাছে ব্যথার যোগান
পুড়িয়ে আমার রাত্রিযাপন।
কেমন করে
এমন রাতে আসলে তুমি?
বজ্র হয়ে এক পলকে
নাকি কোনো দখিন হাওয়া?

আমার পায়ের পথ ফুরলো ঘরের বাঁকে।
আমার ঘুমে শিউলিগন্ধি স্বপ্ন এখন।
আমার বুকে সুর জাগাবে,
সোনার কাঠি রূপোর কাঠি
ছুঁইয়ে ব্যথার ঘুম ভাঙাবে,
এরই জন্য
এত চাওয়ায় বাঁধলে আমায়?

অপেক্ষার পঙ্কতিমালা

একটা নদী ঘুম ভাঙিয়ে রোজ
সকালগুলোর একটা নতুন নাম জানিয়ে
বিকেল হতেই দিঘীর মতন চুপ।
নদীটা কই?
তার কি চোখের জল ফুরলো?

একটা আকাশ স্বচ্ছ ডানায় রোদ।
অন্ধকারের তারায় বোনা কথার ফাঁকে
গাঢ় আদর। বুকের নীচে ডুব।
আকাশটা নেই?
যুদ্ধবিমান ঢাকলো বুঝি?

একটা নারী, মানুষও সে খুব।
ক্রমশ এই দেয়ালগুলো আমায় যখন
পিষতে থাকে, বাড়াতো তার হাত।
কোথায় এখন
সুগন্ধি স্বেদ স্পর্শ নিবিড়?

শিকার

এই বোধহীনতার শেষ
আমি দেখতে চাইছি।
পায়ের তলায় স্লেটনন্দিত ফুটপাথ
রাস্তার কোথায় আবর্জনা মাখে
আমি দেখতে চাইছি।
দেখা এবং না দেখা,
ঘ্রাণেও লুকনো ঘ্রাণ,
শব্দে লুকনো নৈঃশব্দ্য,
আমি সব দেখতে, শুঁকতে ও শুনতে চাই।

প্রিয়তমা,
আমি তোমার জন্য আরেকবার দেখতে চাই।
আমার মৃগয়া
আমি চিনে নিতে চাই।
লক্ষ্যভেদী তীরের ফলায় অন্ধকার চিরে
হাওয়ার ঝাপটায় মেখে দখিন ঐকতান
আমি বিদ্ধ করতে চাই।
কবিতা শিকার করে ক্লান্ত ফিরতে চাই।
জয়ী।

আমি কি একটা
স্বেদসুগন্ধী স্নান আশা করতে পারি?
স্নায়ু টানটান
আমি ছোঁবো,
ছুঁলেই বাজবে।
নাক্ষত্রিক আলোয়
তোমার কোনো প্রসাধনের প্রয়োজন নেই।
একটা কবিতা শিকার করলে
আমি কি পুরষ্কৃত হতে পারি?
আমার দুহাত টনটন করবে ব্যথায়।
আমার পা চলতেই চাইবে না।
তুমি ঘরে টেনে নিও হাত ধরে।
জমানো বুকের কাছটায়,
মাদকতা।
আমার কন্ঠে ঢেলে দিও।
একটা কবিতা শিকার করলে
তুমি কি সমস্তটুকু নারী হয়ে
ঘিরে নেবে আমার ত্রিকাল?

হাত কাঁপে অনভ্যাসের বশে।
স্থিরহাতে ধরেছি পিনাক
শব্দভেদী তীরের ফলা
দর্পচূর্ণী বিষে জর্জরিত।
আকর্ণ টেনেছি জ্যা
জনাকীর্ণ শহরে এখনই
শিকারে নেমেছি।

প্রিয়তমা,
একটা কবিতা শিকার করলে
একটা জনম
একটা ভীষণ বোকা মানুষ
সহ্য করেই কাটবে তোমার?