ভাড়া
সন্ধ্যা নামলে অফিসগুলো থেকে হুড়মুড়িয়ে মানুষজন বেরিয়ে আসে। তারপর প্রাইভেট কার, রিক্সা, বাস…, ফুটপাথে হকার, তারপাশে হাইরাইজগুলো থেকে বেরনো আরো আরো মানুষ… সামগ্রিক ক্যাকোফনি… রাস্তায় পা ফেলার জায়গা থাকে না।
এমন সময় বের হলে মূল তাড়াটা থাকে এই রাস্তা ছেড়ে পালানো। কিন্তু সমস্যাটা এই যে অফিস পাড়ায় ছুটির সময়টায় মাঝারি দূরত্বেও রিকশা পাওয়া দুষ্কর। একে তো সোসাইটির রিকশা ছাড়া গুলশান যাবে না, তার উপর জ্যাম ঠেলে কেউ যেতেও চায় না। কিছুক্ষণ রিকশার খোঁজে এদিক-ওদিক ঘুরে একটা সোসাইটির রিকশা পেয়ে ডাক দিলাম, “মামা যাবেন! গুলশান এক!”
— আসেন মামা।
— কত?
— যা ভাড়া দিয়েন।
রিকশা গুলশান গেলো, যেমন যায়। সারাদিন পরিশ্রম ও ক্যাকোফনিতে রিকশাওয়ালারা ক্রমে মানুষ থেকে ভুত হয়ে ওঠে, আর ভুতের মত রিকশা টানে প্রাইভেট কারগুলোর ফাঁকফোকর গলে, লেন ছেড়ে ওভারটেক করে, সুযোগ পেলে ফুটপাথের ওপর দিয়ে। গুলশানে থামলো রবি অফিসের সামনের রিকশার লাইনের শেষে। মানিব্যাগ থেকে আমি পঞ্চাশ টাকা বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম, নিলো না। আমি আরো দশ টাকা বাড়িয়ে দিলাম। তবুও নিলো না। রিকশাওয়ালা বললো, “টাকা চাই না।”
বিরক্তিকর। বললাম, “তবে?”
— আপনার ইহকাল-পরোকালের আনুগত্য দেন।
— কীহ্!
— আপনার ইহকাল-পরোকালের আনুগত্য দেন।
— মানে?
— ওইটা আমার ভাড়া!
আমি থতমত খেয়ে গেলাম।
— আপনি ভাড়া ঠিক করে উঠছিলেন?
— না।
— তাইলে তো আমি যা চাই দেওয়া উচিত।
— মামা, ইয়ার্কি মারেন?
— অবশ্যই। আমি শয়তান। মানুষের সাথে তো আমার ইয়ার্কিরই সম্পর্ক। এখন আনুগত্য দেন, শপথ করেন।
— আপনি শয়তান?
— কে না? হা হা! কিন্তু আমি আদি শয়তান, সাপ, বিতাড়িত।
— বিপদে ফেললেন। আপনারে মানলে তো ভগবানরেও মানতে হয়।
— হ, তা হয়। আমি হইলাম ভগবানের খুঁত, ব্লাইন্ডস্পট, তার ফ্যাটালিটির প্যাথোস1। আমারে মানলে ভগবানরে স্বীকার করা লাগে, তয় মানা লাগে না। না মানার নাম শয়তান।
— আচ্ছা, দুইজনরেই স্বীকার করলাম, দুইজনরেই মানলাম না। আনুগত্য দেবো না, এখন কী উপায় বলেন।
— না দিলে আপনি কথা রাখলেন না, পাপী। অবশ্য আপনি পাপে ডরান না। ডরান নিজের ইগোর থেইকা ছোট হয়ে যাওয়া। এইটা আপনারে ভোগাবে।
— আর যদি দিই?
— দিলে ধরেন… আমার একটা চন্দনকাঠের সিন্দুক আছে, সেইটায় আটকায় রাখবো আপনার আত্মা।
— লাভ কী!
— জাজমেন্ট ডে’র আগের রাতে ধরেন সব ছাইড়া দিমু। আত্মার জোনাকিরা ফুরফুর করে উড়ে বেড়াবে।
— এই করার জন্য সৃষ্টি থেকে লোকজনরে জ্বালাচ্ছেন?
— অবশ্যই! তা বাদে আপনার আত্মায় আমার কী প্রয়োজন?
স্পিনোজা’র ‘এথিক্স’ অনুযায়ী ঈশ্বর ফ্যাটালিটির বাইরে নয়। ↩