The Starry Night: সেকাল-একাল
১
থিয়ো ভ্যান গঘ্ ভিনসেন্টের একটি চিঠি পেলেন। তারিখ, ২০ সেপ্টেম্বার ১৮৮৯। চিঠিতে থিয়ো-র কাছে ভিনসেন্টের পাঠানো ছবির একটা ফর্দ ছিল তার ‘নাইট স্টাডি’-র। সেই ফর্দে পাঠানোর কথা থাকলেও একটি ছবির পক্ষে বিশেষ কোনো মন্তব্য ছিল না। এমনকি, পরে ছবিটিকে তিনি পাঠাননি, তেমন পাত্তাও দেননি। এই ছবিটিই ভ্যান গঘ্-এর স্টারি নাইট।
ইন্টারনেটের দুনিয়ায় কারো যদি কোনো ক্র্যাফট্ আয়ত্ত্বে থাকে, সে কেক বানানো হোক, নখে রঙ করা হোক, কিংবা ছবি আঁকা, সবার একটা পছন্দ স্টারি নাইট। কোথায় নেই ছবিটি? লকেটে তো আছে, আন্ডারওয়্যারেও1 আছে। এগুলোর কোনোটাতেই আমার আপত্তি নেই, থাকলেও আসলে কিছু যায় আসে না। আমার আগ্রহের বিষয় স্টারি নাইটের একাল-সেকালে। একালে স্টারি নাইটের বিস্তার তো বললাম, সেকালে স্টারি নাইট একটিই আছে, মাস্টারপিস স্টারি নাইট, আগে সেই স্টারি নাইটের কথা বলি।
২
আঠারো’শো ঊননব্বইয়ের সেপ্টেম্বার, মোটের ওপর ইউরোপের শরৎকাল। ভিনসেন্টের আবাস এখন আভিয়োঁ’র (Avignon) এক অ্যাসাইলামে। লোহার শিক দেওয়া জানলায় দাঁড়িয়ে তিনি বাইরেটা দেখেন, আঁকেন অনেক অনেক ছবি। স্টারি নাইটের মতই তিনি অসংখ্য ছবি এঁকেছেন। হয়ত, সেদিন তিনি সারারাত জেগে ছিলেন ভাদ্রের বাতাসে, অথবা ঘুম থেকে উঠেই কী একটা ভেবে আঁকতে বসেছিলেন। যদিও রাতের দৃশ্য, আসলে কিন্তু আঁকা হয়েছিল দিনের আলোয়। শিল্প সমালোচকরা বলেন, পুরোটা ঠিক স্মৃতি থেকে আঁকা না। আবার পুরোটা ঠিক দেখেও আঁকা না। ওই যে গ্রামটা, ওটা ওখানে ছিল না।
এই স্থান-কালের ব্যাপারগুলি ছবিটা, বা ভিনসেন্ট সম্পর্কে আসলে কতটুকু বলে? আত্মহত্যার কয়েকমাস আগে আঁকা এই ছবিটার গুরুত্ব বোঝা যাবে মানুষ ভিনসেন্টের দিকে একবার তাকালে। চিঠিপত্রগুলো পড়লে বোঝা যায় মানুষটা ভয়াবহরকমের সরল ছিলেন। সহজে প্রেমে পড়তেন, সহজে চার্চের স্পীচ দিতেন। তারওপর লোকটা যাকে সহজভাষায় বলে অকেজো লোক। যে পেশাতেই মন দিয়ে কিছু করার চেষ্টা করেছেন, কোনো না কোনোভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। সকল রকমের ব্যর্থতা তাঁকে সারাজীবন তাড়া করে ফিরেছে। সবকিছুতেই সাবলীল, সবকিছুতেই সবার নীচে নিজের জায়গাটা ধরে রাখা। সবকিছুতেই খুব শান্তভাবে বসে থেকে খুব আগ্রাসী মন নিয়ে সবকিছু চেখে দেখা ছিল লোকটার অভ্যাস।
সুন্দর স্টারি নাইটের কথা ভুলে আপনি যদি তার সকল ব্যর্থতাসমেত আভিয়োঁর ওই জানালার গরাদের সামনে দাঁড়ান তাহলে দেখবেন যে স্টারি নাইটের যে শরতের রাত- তেমন রাত পৃথিবীর পরে কখনো নামেনি। ভেনাস কখনো এত ঔজ্জল্য দেখায়নি। চাঁদ তার আকর্ষণে সমগ্র আকাশে ঢেউ তোলেনি। এমন একটা দীর্ঘ গম্ভীর সাইপ্রেস মাথা তোলেনি কোনো ছবিতে। এ একদমই বাস্তব নয়। একজন শিল্পী যখন অকপটে প্রকৃতির সামনে দাঁড়ায়, তখন প্রকৃতিও চুপ করে তার কথা শোনে। এ হচ্ছে ভিনসেন্টের জীবনব্যাপী ব্যর্থতা ও বিষাদের উদযাপন। আর্ট, বস্তুত এই অকপট আত্মকথনে থাকে, সৌন্দর্য মুখ্য নয়।
৩
একালে আমরা স্টারি নাইটের অজস্র ‘কপি’ করছি। বিভিন্ন মাধ্যমে, বিভিন্ন কারণে। এ হচ্ছে আমাদের ক্লিশে সৌন্দর্যবোধে, আমাদের অজ্ঞতার নমুনা। আমরা চাইলেই অকপটে দাঁড়াতে পারি না প্রকৃতির সামনে, প্রিয় মানুষের সামনে। ডেটে গেলে আমাদের অবশ্যই ফটোজেনিক সেলফি দরকার। কাগজে দুটো আঁচড় দিতে জানলেই একটা ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট খুলে পোস্ট করা দরকার। স্টারি নাইট তাই এখন একটা টাচস্টোন, আমাদের ছুঁতেই হয় জাতে উঠতে গেলে। আধুনিক মানুষ এত বেশি সামাজিক যে ব্যর্থতা তাকে কোনোভাবেই মানায় না। তার ভুল করা চলবেই না। দরকার হলে জীবনটা বারবার সম্পাদনা করে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যেন সবাই পছন্দ করে। তাতে শিল্পের জগতে একটু ভিনসেন্ট থাকুক, কবিতার জগতে এজরা পাউন্ড, দর্শনে নীৎশে। আমাদের দরকার সবার অনুমোদন, মৌলিকতাও তার জন্য বিসর্জন দেওয়া যাবে। শিল্পের জগতে আমরা দিনে দিনে শেয়াল ও হায়েনার মত হয়ে উঠছি। অন্যের উচ্ছিষ্টেই আমাদের পুষ্টি।