আমার বাবা

ছুটির দিন। অ্যাসবেসটস্ টিনের ঘর। দুপুরটা আগুন হয়ে থাকে। দরজা-জানলা সব খোলা। জানলার ওপাশে অবশ্য একটা দেয়াল, বাতাস বিশেষ আসে না। স্কুলগামী এখনও হয়নি এমন একটা ছেলে বসে আছে খাটের ওপর। আর একজন মধ্যবয়সী লোক। লোকটার কথা ছিল পড়ানোর, কিন্তু দুজন মন দিয়ে কাটাকুটি খেলছে। খেলার স্কোর গুনলে ছেলেটাই জিতে যায় বারবার। ছেলেটা আমি, লোকটা আমার বাবা।

আমার বাবা বরাবরই তার সন্তানদের কাছে হেরে যেতে চেয়েছিলেন। কোনোভাবে আমরা যেন তাঁকে ছাড়িয়ে যাই। সে গল্প পরে হবে।

ইঁচড়ে পাকা ছিলাম তবে চৌকস ছিলাম না মোটেও। আমার অগ্রজ বরং লক্ষ্মী ছেলে। বাবা ওকেই পড়িয়েছেন বেশি, আমাকে বলেছেন গল্প। তার ওপর সমস্যা হচ্ছে, বকলে জ্বর চলে আসে। শাসন-টাসন বেশি তাই করা গেলো না। ছোটবেলায় নামমাত্র যে পড়ালেখা তা কিন্তু নিজেই করে নিতাম। কী দরকার সপ্তাহের একটামাত্র ছুটিরদিন পড়ার পিছনে দেওয়ার? কাটাকুটি খেলা বরং ঢের ভালো।

ফেব্রুয়ারি, ২০১৩। রাত… গ্রামের রাত। আটটা কি দশটা মনে নেই, সব একরকম। মায়ের আর্তনাদ। ছুটে গেলাম ওইঘরে। বাবার শরীর খারাপ। কোনো কাকা বুঝি গেলো ডাক্তার ডাকতে। বাবা ইতমধ্যে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। পালস্ দেখলাম। মা ঠিক বুঝতে পারছে না কী ঘটে গেছে। আমি কিচ্ছু বলছি না, ডাক্তারই বলুক এসে।

আমি অন্যঘরে শুয়ে আছি অন্ধকারে। কান্না শুনছি, অনেকগুলো কন্ঠের, বারান্দায়, পাশের ঘরে। আমি কাঁদিনি। আমি সম্ভবত খুব শান্তভাবে নিয়েছি যতদূর মনে পড়ে। মৃত্যুটাকে আমি এত সহজভাবে নিয়েছি যে অবাক লাগে মাঝেমধ্যে।

ভোরবেলায় বেরিয়ে গেলাম খেয়াঘাটে। সাথে বুঝি কেউ ছিল, মনে নেই। সিগারেট ধরিয়ে দাঁড়ালাম ফেরির কাছে, কয়েকজনকে ফোন করে জানালাম ব্যাপারটা। দিনটা কেটে গেলো একরকম। পারিবারিক প্রথায় সমাধি হলো। সমাধির আগে আগে আমাদের কিছু খেয়ে নিতে বলা হলো, খেয়েও নিলাম পেটভরে। না, সেন্টিমেন্টাল আমি নই। আমাকে বলার দরকার নেই যে “বাপ-মা কারো চিরদিন থাকে না”। শেষকৃত্যের পর স্নান করে ব্রহ্মচারীর বেশ নিতে হলো। শীত করছিল মনে আছে। ফেব্রুয়ারি, শীতেরই সময়।

শীতকালের সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হচ্ছে গরম ছিল না। গরম মানেই ঘামাচি আর ভয়াবহ যন্ত্রণা। শীতকালে বরং বাবা লেপ-কাঁথা কিছু গায়ে চাপিয়ে বুকের নীচে বালিশ দিয়ে উবু হয়ে শুয়ে বই পড়ত। আমি লেপের ভেতরে ঢুকে গিয়ে পড়া শুরু করতাম তার সাথে। আমার মনে আছে, বাবা খুব ধীরে ধীরে পড়তেন, আমি পড়া শেষ করে অপেক্ষা করতাম কখন তিনি পাতা ওল্টাবেন। সে উপন্যাসের পুরো স্বাদ নেওয়ার মত দাঁত তখনও আমার গজায়নি হয়ত। তাতে কি! না বুঝলে পড়া যাবে না এমন কথা তো কেউ কখনো আমাকে বলেনি। অগ্রজের ভাষ্যমতে একবার জ্যোতিপদার্থবিদ্যার একটি পাঠ্যবইয়ের কয়েকপাতা পড়ে ফেলেছিলাম কিছু না বুঝেই। অতএব হুমায়ূন, সুনীল, সঞ্জীব এবং টিনটিন, চাচা-চৌধুরী ও সকলরকম কমিকস্ সমানে পড়া চলতো।

একদিন আলমারির নীচের তাক থেকে একটা পুরোনো বই নতুন করে বের করলেন বাবা। নিশ্চয়ই অগ্রজ পড়েছে আমার আগে। বইটার নাম ‘ছোটদের বুক অব নলেজ’। ইয়া মোটা একটা বই! আমার তুলতে কষ্ট হবে এত মোটা। প্রচ্ছদে একটা লোক(অ্যাটল্যাস) বলের মত একটা জিনিস(পৃথিবী) ঘাড়ে করে ধরে আছে। তখন আমার জগত বলতে, হালদারপাড়া, সেটা হচ্ছে খুলনার মধ্যে, তারপর আমার দেশ, তারপর বিদেশ, উপরে একটা আকাশ, নীচে হালদারপাড়া, মানুষজন সব অনেক বড়, আমি খুব ছোট্ট। হঠাৎ করেই জানা গেলো, আকাশের বাইরে মহাকাশ আছে, লোকে রকেটে করে সেখানে যায়, এমনকি চাঁদেও। আর পৃথিবী গোল। বিদেশ কোনো একটা দেশ না। আর এই যে আমরা মানুষ, আমাদের আর বানরের পূর্বপুরুষ এক। আর জাপানিরা কাঁচা মাছ খায়, আর সমুদ্রের নীচে অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস আছে। আমি যখন বড় হবো তখন কী কী করতে হবে তার তালিকা বড় হতে থাকলো। তার কিছুই করা হয়নি, তবে তালিকা হয়েছিল তাতেও আমি কম খুশি নই।

অন্যদের বাবারা খেলনা কিনে দিতে, আমার বাবার সে সামর্থ্য ছিল না। এমপিওভুক্ত স্কুলশিক্ষকদের মত নিপীড়িত এদেশে আর কোনো চাকরিজীবী নেই। বই কেনা হত অবশ্য, এবং আমি আজন্ম আলমারি ভর্তি বই দেখেছি। খেলা বরং আবিষ্কার করে নিতাম।

একাদশ শ্রেণীতে পড়ি তখন। ওই বয়সে ভেতরটা থাকে টগবগে। সবসময় ফুঁসছি। খুশি থাকলে খুব খুশি, বাকি সময়টা প্রচণ্ড রোষ, কেন কে জানে! ইতমধ্যে আমি যথেষ্ট ‘ডোন্ট কেয়ার’ মনোভাবের, স্নব। কৈশোর হচ্ছে তরুণ হয়ে ওঠার সময়। আর তারুণ্যের তো ভয়াবহ শক্তি। আমার বেশ কষ্ট হত নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। তখন বাবার সাথে প্রায়ই মনমালিন্য হত। কে ঠিক ছিল, কে ভুল ছিল তা আজ এতদিন পর নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নেই। তখন তো মনে হত আমিই ঠিক। একদিন তো রেগে গিয়ে চিৎকার করে ঘুরে দাঁড়াতেই পায়ে লেগে শোকেসের কাঁচ গেল ভেঙে। আমি তো ভ্যাবাচ্যাকা। কিন্তু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছি তা তো বুঝতে দেওয়া যাবে না! বেরিয়ে গেলাম বাড়ি থেকে। একা একা হাঁটতে থাকলাম যেদিকে পা চলে। এমন কয়েকবারই হয়েছে।

তখন, নিজেকে ছাড়া কাউকেই চোখে পড়ত না আমার। বয়সন্ধির সময়টা আমার সাথে কেমন ব্যবহার করা হয়েছে তার গভীর বিশ্লেষণের মত নৈর্ব্যক্তিক তথ্য আমার হাতে নেই। তবে আমার বাবা-মা অন্যদের চেয়ে বেশি সহনশীল ছিলেন এটা ঠিক। আমি সেই তুলনায় রীতিমত বেয়াদব ছিলাম। এই সময়টায় বাবার সাথে আমার একটা দূরত্ব তৈরী হয়।

পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি। আমার স্কুল থেকে আমার বাবাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। আমাকে টিসি দেওয়া হবে। শাস্তির কারণ, আমি নাস্তিক। টিসি তখন আমার কাছে ভয়াবহ শাস্তি। তবু আমি বিচলিত নই, কেননা প্রায় মার্টয়ারডমের মত লাগছিল ব্যাপারটা। যাহোক, বাবার জন্য সম্ভবত বিষয়টা অস্বস্তিকর ছিল। কিন্তু তিনি ভালোভাবে ব্যাপারটা সামাল দিয়েছেন। মোটামুটি মাসখানেকের মত স্কুলে আমাকে মানসিক চাপের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।

আমার বাবা বিশ্বাসী মানুষ ছিলেন। বিশ্বাসী শুধু না, অরবিন্দের pseudo-scientific ধাপ্পাবাজিতে বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে অবিশ্বাসকে প্রশ্রয় দেওয়া সুখকর না। তবে, মানুষ হিসেবে তাঁর একটা ভালো গুণ হচ্ছে তিনি এবং তিনিই যে সবকিছুতে ঠিক- এমন বিশ্বাস তার ছিল না। এজন্য কখনো আমার ওপরে কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। তার জীবন নিয়ে তার যথেষ্ট হতাশা ছিল। তবে ওইযে, নিজের জীবনে যা হয়নি তা আমাদের দিয়ে করাতে হবে এই অসুস্থতায় কখনো ভোগেননি।

“তুমিও আমাদের খুব প্রিয় তোমার দাদার মত। এমনিতেও বড় ছেলেরা একটু বেশি আদর পায়। তারওপর তোমার দাদার আগে আমাদের একটা অ্যাবরশন হয়…” এটুকুর পর আমি সেদিন বিশেষ কিছু শুনিনি। কেননা, তখন আমার কাছে অ্যাবরশন হত্যার সমান। বাস্তবতা হচ্ছে, আমার অগ্রজ যখন জন্মগ্রহণ করেছে আমার মা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে তখন। নিশ্চয়ই সেই সন্তান হওয়ার সময় মা আরো ছোট ছিল। ওইসময় দুজনেরই হয়ত জীবনের ঝুঁকি ছিল। এমনকি নিতান্ত দারিদ্র্যের জন্যও যদি অ্যাবরশন করায় একটা পর্যায়ে আমি এখন আর তাকে হত্যা বলবো না। কিন্তু এ যখনকার কথা তখন আমি কেবল কৈশোরে পা দিয়েছি। ফলে, আমার সামনে আমার পিতার বিশাল ভাবমূর্তি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়লো।

আমি বাবাকে আদর্শ ভাবতাম। তিনি তার পেশায় যত্নবান, সংসারে স্নেহশীল। অমুকের চিকিৎসা, তমুকের একটা পেশার ব্যবস্থা করে দেন তিনি। এমনকি ক্ষুধার্ত চোরকেও ভাত রেঁধে খাওয়ান। এমন মানুষ করলো অ্যাবরশন?! আমার হিসেব মিলছিলো না কিছুতেই, মেলেওনি অনেকদিন। দূরত্বে বাড়তে বাড়তে আমরা খুব আলাদা ধরণের মানুষ হয়ে উঠলাম। আমি কিছুতেই শান্ত-শিষ্ট হলাম না, বরং প্রচণ্ড উগ্র, ঠোঁটকাটা হয়ে উঠলাম।

পিছন ফিরে দেখলে এই দিনগুলো আমি মুছে ফেলতে চাই। অথচ, আমি জানি, এটার দরকারও ছিল। আমি কোনোদিন আমি হয়ে উঠতাম না, আমার বাবার ছায়া হয়ে থাকতাম যদি বাবাকে মানুষের কাতারে নামাতে না পারতাম। আমার বাবাও ভুল করেন। আমার বাবাও অন্যায় করেন।

আমি বাবাকে এরজন্যে ক্ষমা করেছিলাম বহুকাল পরে, তিনি যখন আংশিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে শয্যাশায়ী। তখন তাকে নিয়ে ফিজিওথেরাপি দিতে যেতে হত। মনে আছে, একদিন ঘরে শুয়ে আছেন, হাতে একটা নরম বল, ওটা মুঠো করে ধরা একটা ব্যায়াম তারজন্যে। কিছুতেই পারছেন না। আমি বসে বসে দেখছি। আমার সমস্তকিছু মনে পড়ছে। শৈশব, কৈশোর, অ্যাবরশন, আমার দুর্ব্যবহার… তারপর, আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। তার হাত ধরে মুঠো করে দিলাম বলটার গায়ে। অনেকদিন পর সবকিছু ঠিকঠাক লাগছিলো সেদিন।

একটা সময় ছিল, যখন সবকিছু একদম ঠিকঠাক ছিলো। ছুটির দিন সকাল সকাল উঠে আকাশবাণী কোলকাতায় প্রাত্যহিকী শোনা হত। আমার বাবা রেডিও শুনতে ভালোবাসতেন। আর ভক্ত ছিলেন কবীর সুমনের। সুমনের প্রচুর অ্যালবাম, কাজী সব্যসাচী ও জয়ন্ত চট্টপাধ্যায়ের আবৃত্তি এবং প্রচুর রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট ছিল বাসায়। এমনকি একটা গ্রামোফোনও ছিল, অনেকগুলো রেকর্ড। অবশ্য, সেগুলো আমি শুনিনি কখনো। এইদিক থেকে তাকে বেশ আমুদে লাগত আমার। এমনকি, রাতের রহস্য নাটকের সময় তিনি মাঝেমধ্যেই বাতি নিভিয়ে দিতেন। তাতে গা ছমছমটা আরে বাড়ত।

সকালে আমরা একসাথে খেতে বসতাম। আজকাল তেমন দেখিনা, আগের সময় চালে অনেক খুদ হত। দরিদ্র পরিবারে সেসব ফেলে দেয়া চলে না। জমিয়ে রাখা খুদের সাথে ডাল আর শাক দিয়ে করা একটা খিচুড়ি, সাথে জলপাইয়ের আচার আর শুকনো মরিচ পোড়া। সে আরেক জন্ম দূরে মনে হয় আজকাল।

সন্ধ্যায় পড়তে বসার সময়। শুধু এই পরিবারের পড়ার নিয়মকানুন আলাদা। প্রথমত, পাঠ্যবই পড়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, এমনকি পড়াটা বাধ্যতামূলক তেমনটাও কেউ বলেনি। সবাই পড়ত, আমি না পড়ে একা একা কী করবো? তো, আমি গিয়ে দেখলাম বাবা টেবিলে পা তুলে চেয়ারে বসে পড়ছেন। আমারো তেমন পড়া চাই! কিন্তু ওই চেয়ার থেকে টেবিলে পা তুললে আমার বসার জায়গায় শুয়ে পড়তে হয় এই যা একটু অসুবিধা! তবু বাপ-ব্যাটায় টেবিলে পা তুলে পড়ছি।

পড়া মুখস্থ না হওয়া পর্যন্ত চেঁচিয়ে পড়ার নির্যাতনও আমার ওপর কখনো চলেনি। বরং বাবা চুপচাপ পড়তে উৎসাহ দিতেন। বলতেন বুঝে পড়তে।

প্রথম শ্রেণী শেষ করার পর পরীক্ষার বার্ষিক ফলাফল পেয়ে আমি বাসায় ফিরেছি কাঁদতে কাঁদতে। কিছুতেই কান্না থামানো যাচ্ছে না। কেননা আমি ফেল করেছি। লিজা নামে একটা খুব মুডি মেয়ে শুধু পাস করেছে। আসলে পাস-ফেলের ব্যাপারটা আমায় কেউ বলেনি। আমি ভাবতাম, ফার্স্ট হলে শুধু পাস করে, বাকি সব ফেল। ফেল করাটা খুবই গর্হিত ব্যাপার। প্রথম বছরেই এমন একটা বিষয় হজম হচ্ছিল না। আমার বাবা অবস্থা দেখে না হাসার চেষ্টা করেছেন নিশ্চয়ই। খুব গম্ভীরভাবে বললেন,”ফেল করলে কিচ্ছু হয় হয়না। এসো, তোমায় একটা গল্প লিখে দিই।” গল্প লেখা শুরু হলো। আমার মত একটা ছেলে, সে সেকেন্ড হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছে কেননা সে মনে করেছে সে ফেল। গল্পের গাঁথুনি কেমন? আহামরি কিছু না। জাতীয় দৈনিকে যে শিশুদের বরাদ্দ যে পাতাটা থাকত ওখানে যেমন অতি সহজ-সরল লেখা হয় তেমন আরকি। কিন্তু এ যে আমায় নিয়ে গল্প, তারওপর বাবার হাতের লেখা অনাবশ্যকরকমের ভালো! আমি পেয়ে এমন খুশিতে ডগমগ করে উঠলাম যে ভুলে গেলাম ফেল(!) করেছি।

গল্প সহজে ফুরনোর নয়, ইতি টানবো এইবেলা। আমার বাবার সবচেয়ে ভালো ব্যাপারটা কী? তিনি বেশি বাবাগিরি ফলাতে যাননি। তিনি আমাকে মানতে না, চিন্তা করতে শিখিয়েছেন। আমি কোনো বনসাই না, কারো চাওয়ার মাপে আমাকে গড়া হয়নি। আমি মহীরুহও হয়ত নই, তবে আমি গুল্ম হই বা বৃক্ষ, আমি নিজের মত বেড়ে ওঠার সুযোগটা পেয়েছি। আকাশ ভরা সূর্য-তারায় আমার যে স্থান, যে বিস্ময়, সে আমাকেই খুঁজে দিতে হয়েছে, হচ্ছে।

বাবা যখন জীবিত ছিলেন, তখন এতই প্রচ্ছন্নে ছিলেন আমার জগতে যে অধিকাংশ দিনে তাকে চোখেই পড়ত না। নিজেকে সম্পূর্ণ মনে হত।

আজকাল বরং বাবাকে বেশি খুঁজতে থাকি। আজকাল বরং বুঝতে পারি প্রয়োজনটা। আমার সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা অতি নিম্নমানের। যখন মানুষের সাথে কথা বলতে যাই, যখন কাউকে খুব সহজ কিছু বলে বোঝাতে পারি না তখন ভিতরে হাতড়ে বেড়াই বাবা হলে কী করতেন। তখন আমি আমার বাবার সাথে নিজেকে একটা ভেলায় আবিষ্কার করি খরস্রোতা নদীর মাঝে। দুজনেই যদি ভুলজায়গায় দাঁড়াই তো ভেলা যাবে উল্টে! আমি রেগে গিয়ে কিছু বলতে এগিয়ে গেলেই আমার বাবা তার ধৈর্য নিয়ে পিছিয়ে দাঁড়ান। আজ এতবছর পরেও আমার বাবা আমাকে খুব গোপনে মানুষ করে যাচ্ছেন।

অনেক ক্ষোভ ছিল তাঁর ওপর। আজকাল বরং মনে হয়, আমি আমার সন্তানের বাবা ঠিক এরকমই হতে চাই।