অ্যানাইলেশন অব কাস্ট: বি.আর. আম্বেদকার

AoC ভারতবর্ষের ইতিহাস তার ভুখণ্ডের মতই বিস্তৃত ও প্রাচীন। যে অংশটা আমাদের বিদ্যায়তনে পড়ানো হয় তা মূলত গত দুই শতকের বিপ্লব ও স্বাধীনতার ইতিহাস। বৃটিশদের হাতেই দুটি ভাগে ভাগ হলো ভারতবর্ষ। তার পঁচিশ বছর যেতে না যেতেই পাকিস্তান ভেঙে হলো দুটি দেশ। স্বাধীনতাই যে এই উপমহাদেশের মানুষের একমাত্র প্রয়োজন ছিল না তা এতদিনে আমরা বুঝে গেছি। সুশিক্ষার অভাব এবং আমাদের বহুযুগের কুসংস্কারের আধিক্যে আজও এই উপমহাদেশে হীনবল। আমাদের সকল সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর আমি মনে করি সাম্প্রদায়িকতা। এই বইয়ের বিষয়বস্তু এক বিশেষ ধরণের সাম্প্রদায়িকতা যা হিন্দুধর্মের মজ্জাগত একটি বিষয় যাকে আমরা বর্ণবাদ বলে জানি।

‘জাত-পাত তোড়ক মণ্ডল’ নামের একটি সংগঠন (মূলত কিছু দেশহিতৈষী উচ্চবর্ণের মানুষের প্রচেষ্টার ফসল) ড‌. আম্বেদকারকে তাদের একটি সভার সভাপতিত্ব করতে অনুরোধ জানান। পরবর্তীতে মণ্ডলের তুলনামূলক নরম অবস্থানের সাথে আম্বেদকারের না মিললে তিনি সভাপতি হওয়া থেকে বিরত থাকেন। সেই সভার বক্তৃতাটি তিনি মুদ্রণ ও বিতরণ করেন ‘Annihilation of Caste’ নামে। এই বইটির শেষ সংস্করণে যুক্ত হয়েছিল এই বইয়ের প্রতিক্রিয়ায় লেখা গান্ধীর উত্তর ও তার পাল্টা উত্তর। এগুলোর সাথে আম্বেদকারকে নিয়ে লেখা অরুন্ধতী রায়ের একটি প্রবন্ধ এবং প্রচুর টীকা সমেত একটি সংস্করণ করেছে লন্ডনের ভার্সো(Verso) প্রকাশনী। আমি সেটাই পড়েছি। বইটি নিয়ে কিছু বলার আগে আমার মনে হয় কিছু কিছু ব্যাপারে একটু বলা দরকার।

হিন্দুধর্ম ও হিন্দুত্ববাদ

ধর্ম হিসেবে হিন্দুধর্মের বয়স কম, হিন্দুত্ববাদের বয়স আরো কম। যারা ইতমধ্যে আমাকে হাজার-হাজার বছর পুরনো হিন্দুধর্মের গল্প বলার কথা চিন্তা করছেন তাদের জ্ঞাতার্থে বলি, হিন্দুরা নিজেদের হিন্দু বলে জেনেছে বহিরাগত জাতিগুলো আসার পরে। এমনকি বৌদ্ধ ও জৈনদের তারা আলাদা ধর্ম বলে স্বীকার করত না। সে অর্থে হিন্দুধর্মের বয়স খুবই কম। হিন্দুত্ববাদ হিন্দুধর্মের রাজনৈতিক দর্শন, এর উৎপত্তি ও বিকাশ ব্রিটিশ শাসনামলে। বৈষ্ণব ও আরো কিছু সম্প্রদায়ের দর্শন উদার হলেও মূলধারার হিন্দুধর্ম খুবই অমানবিক ও সহিংস।

বর্ণাশ্রম ও জাতিবাদ

হিন্দুধর্মে বর্ণবাদ ও জাতিবাদ ভিন্ন ধারণা। মনুসংহিতায় হিন্দুদের চারটি বর্ণে ভাগ করা হয়েছে। শ্রেষ্ঠত্বের ক্রমানুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র। বস্তুত গুণাবলির দ্বারা বর্ণ নির্ণয়ের নিয়ম থাকলেও ক্রমে তা জন্ম দ্বারা নির্ণয়ই রীতি হয়ে ওঠে। এই চারবর্ণের বাইরে সবাই অবর্ণ ও অস্পৃশ্য। অপরপক্ষে, জাতি পুরোপুরিই জন্মের ওপর নির্ভরশীল। সময়ের সাথে ব্যবহারিকক্ষেত্রে দুটোর পার্থক্য ম্রিয়মান হয়ে এসেছে। বর্ণে-বর্ণে, জাতিতে-জাতিতে সম্পর্ক ও মেলামেশায় বিধি-নিষেধ আছে।

আম্বেদকার: যে বীরের গাঁথা নেই

আম্বেদকার এসেছেন অস্পৃশ্য জাত থেকে। তারা বিদ্যা ও ধনগ্রহণে অযোগ্য, ভালো পোশাক, অলঙ্কার পরলে বা ঘি খেলেও যাদের শাস্তি পেতে হয়। সবর্ণ হিন্দুরা যাদের ছায়াও মাড়ায় না, যাদের সংশ্রব এড়িয়ে চলে। বস্তুত এ দাসত্বেরই নামান্তর। কোনো কোনো দেশে দাসদের চাইলে মুক্তি দেওয়া যেত। মুক্ত হওয়া দাস নিজের চেষ্টায় জীবনের উন্নতির চেষ্টা করলে কারো কিছু বলার ছিল না। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো জাত থেকে কোনো মুক্তি নেই।

তো এই আম্বেদকার ব্রিটিশদের শাসনে শিক্ষার সুযোগ পেলেন। পেলেন এক রাজার আনুকূল্য। বিদেশে পড়লেন সেখানে সম্মান পেলেন। কিন্তু দেশে ফিরে তিনি সেই অস্পৃশ্যই রয়ে গেলেন।

আম্বেদকার সংগ্রাম করলেন। নিষ্পেষিত মানুষদের জন্য। কংগ্রেসের মত গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল সবসময়ই তাকে শত্রুর কাতারে ফেলেছে। বলা হয়, গান্ধীর সবচেয়ে বড় শত্রু তিনি। বলা হবেই বা না কেন? স্পষ্টভাষী ও বাস্তববাদী তিনি। বিনয় ছিল যথেষ্ট তবু সত্যের খাতিরে গান্ধীর সফেদ ভাবমূর্তি কাদায় মাখামাখি করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। ব্যক্তি হিসেবে গান্ধী সারাজীবনই স্বার্থান্বেষী ছিলেন। প্রচণ্ড মৌলবাদী হলেও সময়মত ভোল পাল্টাতে তার দ্বিধা ছিল না। অরুন্ধতী রায়ের মতে:

The trouble is that Gandhi actually said everything and its opposite. To cherry pickers, he offers such a bewildering variety of cherries that you have to wonder if there was something the matter with the tree.

তাছাড়া খুব ইনিয়ে-বিনিয়ে সাফাই গাইতেও তার জুড়ি ছিল না। জাতিবাদ নিয়ে তিনি বলেন:

Caste is another name for control. Caste puts a limit on enjoyment. Caste does not allow a person to transgress caste limits in pursuit of his enjoyment. That is the meaning of such caste restrictions as inter-dining and inter-marriage … These being my views I am opposed to all those who are out to destroy the Caste System.

আম্বেদকারের সংগ্রাম তখনকার স্বরাজের সংগ্রাম থেকে অধিকতর কঠিন ছিল। স্বরাজের আন্দোলন বস্তুত নিজেদের দেশের ওপর নিজেদের কর্তৃত্বের দাবী। কিন্তু এইসব অস্পৃশ্য জাতির দেশ থেকেও নেই। গান্ধীর সাথে আম্বেদকারের প্রথম সাক্ষাত সম্পর্কে অরুন্ধতী রায় লিখেছেন:

In 1931, when Ambedkar met Gandhi for the first time, Gandhi questioned him about his sharp criticism of the Congress (which, it was assumed, was tantamount to criticising the struggle for the Homeland). “Gandhiji, I have no Homeland,” was Ambedkar’s famous reply. “No Untouchable worth the name will be proud of this land.”

এই অবস্থান থেকে ছিল তার লড়াইটা।

তার চরিত্রের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই সমস্ত বিষয়ে তার প্রচণ্ড আবেগ থাকলেও তার লেখায় তিনি যুক্তি-প্রমাণের বাইরে এক পা-ও হাঁটেননি। অর্থাৎ, আলোচনায় তিনি নৈর্ব্যক্তিক।

পাঠপ্রতিক্রিয়া

এই বক্তৃতার শ্রোতা হওয়ার কথা ছিল মূলত শিক্ষিত হিন্দুসমাজ। তাত্ত্বিক বিষয়গুলো চেষ্টা করেছেন শিক্ষিতসাধারণের বোধগম্য করতে। তিনি জাতিবাদ ও বর্ণবাদের উৎপত্তি ও বিস্তার, তার কর্মপদ্ধতি ও মনস্তত্ত্ব, গভীরতা ও প্রভাব কখনো উদাহরণ দিয়ে, কখনো শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বুঝিয়ে বলেছেন। জাতিবাদের পক্ষের আলোচনার দাবিগুলো খন্ডন করেছেন আধুনিক সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব এবং বিজ্ঞানের আলোকে। সমসাময়িক অন্যান্য প্রচেষ্টার নির্মোহ মূল্যায়ন করেছেন। চেষ্টা করেছেন সমাধান দিতে। এতই সংহত ও শক্তিশালী লেখা যে এটার বিরুদ্ধে লেখা গান্ধীর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তি বলতে কিছু ছিল না।

এখন, কারো কারো কাছে এটি ঐতিহাসিক দলিল। ঐতিহাসিক ব্যর্থতার দলিল, কেননা এখনো শুধু ভারতে ১৬কোটি অস্পৃশ্য মানুষের বাস। ব্যর্থতা আম্বেদকারের না, হিন্দুদের। যে ব্যর্থতার কথা বলেছিলেন আম্বেদকার। শুধু একটি মূর্খ জনগোষ্ঠী কর্ণপাত করেনি:

But the world owes much to rebels who would dare to argue in the face of the pontiff and insist that he is not infallible. I do not care for the credit which every progressive society must give to its rebels. I shall be satisfied if I make the Hindus realise that they are the sick men of India, and that their sickness is causing danger to the health and happiness of other Indians.