প্রিয় বাংলাদেশ

প্রিয় বাংলাদেশ, তুমি কোথায় যাচ্ছ? তোমার বয়স এখনো অর্ধশতক ছোঁয়নি। আমার ছোঁয়নি তারও অর্ধেক। অথচ, এই ক্ষুদ্র সময়ের ভেতর তুমি অচেনা হয়ে গেছ। আমি তোমায় বোধহয় আজকাল সামান্যই চিনি।

রাষ্ট্রতাত্ত্বিক সংজ্ঞায় তুমি রাষ্ট্র বটে। কিন্তু, রাষ্ট্র তো আমার দেশ নয়। রাষ্ট্র তার ভুখণ্ডে একটি জনগোষ্ঠীর যন্ত্রাচার। দেশের মত তার ভাষা নাই, কাতরতা নাই। তুমি তো দেশ ছিলে, বর্ষায় মেঘমল্লারের মত তোমার বুকের উঠোন থৈথৈ করত। হেমন্তের হাওয়ায় কেবল হাহাকার। বসন্ত ছিল সরোদের মত। যদি কোথাও প্রবল প্রেমের সুর বাজে, তরাবের মত বিরহ তার সঙ্গ নেয়। ছিলে তো আমার দুঃখ-সুখে, কবে শুধুমাত্র রাষ্ট্র হয়ে উঠলে? রাষ্ট্রের নীতিতে আমি দ্বিতীয়শ্রেণীর নাগরিক। রাষ্ট্র আমাকে কখনোই স্বীকার করেনি নিজের বলে। তার সকল নিস্পৃহতাসমেত সে আমার জীবনের দায়ভার এড়িয়ে গেছে। আমার দেশ আমাকে টেনে নিয়েছে, আমাকে বলেছে যুদ্ধ করতে, আমাকে বলেছে যা কিছু সত্য, যা কিছু সুন্দর বলে জানি তার জন্য জীবন বাজি রাখতে। রাষ্ট্র আমাকে চেনেনা। আমি এই রাষ্ট্রকে চিনতে অস্বীকার করছি। দেশপ্রেমিক আমি, এবং রাষ্ট্রদ্রোহী।

বাংলাদেশ, তোমার খোলসে, যন্ত্রের বুনুনিতে কেবল মরিচা, কেবল ঘুণ। একসাথে এতগুলো অসৎ মানুষ তুমি কখনো দেখেছ? এতগুলো মানবেতর জীব? কী মানুষের, কী কুকুরের, গর্ভবতী মহিলা বা পাগল, ছয় বছরের শিশু বা বাসে করে অফিসে যাওয়া ছাপোষা মানুষ কারো নিস্তার নেই। এত হত্যা, এত ধর্ষণ, এত নৃশংসতা কখনো দেখেছ জন্মাবধি? যে প্রগাঢ় আঁধার নামছে, চোরাবালির মত, তুমি সেখানে ক্রমশ ডুবে যাচ্ছ। এ আঁধারে আলোর অভাব নেই, বরং ব্যক্তিগত অন্ধত্বের সামষ্টিক রূপ এই অন্ধকার। সংস্কার ও মিথ্যার অন্ধকার। আমাদের দ্বিচারিতা আমাদের ধর্মে, কাজে, দেশপ্রেমে, সর্বত্রই।

অথচ তুমি ছিলে, “পৃথিবীর মানচিত্রের থেকে ছিঁড়ে নেওয়া সেই ভূমি”- একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত ভূখণ্ড ও জাতির সম্মিলিত স্বপ্নের ভেতরে। মাটির প্রতিটি ইঞ্চি রক্তাক্ত ছিল। ছিলো নিরন্ন মানুষের জ্বলজ্বলে চোখ। এমনকি আশির দশকেও তো মানুষের স্বর ছিল, ঢল ছিল রাজপথে। কিন্তু কোথায় ভুল ছিল?

পৃথিবীতে মানুষের যতদিন বাস, তার প্রায় কাছাকাছি দিন তারা মানবেতর। সে হিসেবে তুমি শিশু। তোমার গণ্ডি কখনো আমার গণ্ডি নয়। হয়ত গণ্ডিটা রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র নাকি আজকাল উন্নয়নশীল। পৃথিবীর যাবতীয় উন্নয়নের সূচক তেড়েফুঁড়ে অতিক্রম করছে। অথচ কয়েকটা নগর ও বন্দরের ঝলমলে আলো বাদে ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল আমি শুধু অন্ধকার দেখি। দেখি মানুষ অভাবে সপরিবারে আত্মহত্যা করে, গ্রাম ছাড়ে, দেশ ছাড়ে। আমার হতাশ লাগে। আমি তখন একই সাথে পালাতে এবং থাকতে চাই। এমন না যে আমি বড় কিছু করতে পারবো কিন্তু আমার ছায়া পর্যন্ত দেশের মাটির ঘ্রাণ বহন করে, অস্তিত্ব থেকে দেশ মুছে ফেলা সহজ না। ঠিক এইসব সময়ে আমি বুঝতে পারি, এই দেশ, এই দরিদ্র অশিক্ষিত মানুষেরা আমার। তাই আমি এই রাষ্ট্র চাইনা। আমি চাই এর ওপর ধ্বংস নেমে আসুক।

প্রিয় বাংলাদেশ, আমি আস্থা রাখি মানুষে। এই প্রগাঢ় অন্ধকারেও কোথাও কোথাও আলো দেখা যায়। আমি দেখেছি মানুষেরা এখনো মানুষের পাশে দাঁড়ায়, ভালোবাসে। হয়ত সত্যিই এই অন্ধকারের পর ভোর হবে। যেখানে মানুষ সত্য, আর মানুষের অন্তরাত্মার সত্যের ভেতরে তুমি দেশ হয়ে ওঠো, সেইখানে, “তোমার প’রে ঠেকাই মাথা”।


কর্মক্ষেত্রের একজন সহকর্মীর উদ্যোগে আমরা প্রত্যেকে কিছু লিখেছিলাম। মূল সুরটা ছিল ‘প্রিয় বাংলাদেশ’। এই লেখাটি ছিল আমার পক্ষ থেকে।