ফর নো রাইম অর রিজন...

মৃত্যু তো আমার কাছে নতুন কিছু না, যখন বয়স সদ্য একুশ (২০১৪ সাল) তখনও না। ইতমধ্যে আমি যথেষ্ট মৃত্যু দেখেছি। আমার পিতৃবিয়োগ হয়েছে তখন বছরখানেক আগে। তবু মৃত্যু নিয়ে একরকম কার্য-কারণ ধারণা ছিল আমার মধ্যে। সেটাই ভেঙে পড়ল হুড়মুড়িয়ে, ৩০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় তার শুরু।

৩০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় জানা গেলো, আশরাফুল খুন হয়েছে। তার পরিবার থেকে জানালো এলাকার পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকে এমন কাজ হতে পারে বলে তারা সন্দেহ করেন। কিন্তু আদতে ঘটনাটা মোটেও এরকম না। আনসারুল্লাহ্ বাংলা টীমের ফেসবুক পেজ থেকে জানানো হলো ব্যক্তিগত জীবনে নাস্তিকতা চর্চার জন্য তাকে খুন করা হয়েছে।

আশরাফুলকে আমি চিনি তার বেশ আগে থেকে। অন্য বন্ধুদের তুলনায় রীতিমত নতুন বন্ধু। কিন্তু, সত্যিকার অর্থে আমার শহরে(অর্থাৎ খুলনায়) আমার বয়সী আমার মত ভাবে এবং বিনয়ের সাথে বললেও, সমবয়সীদের মধ্যে আমার যোগ্য আর কোনো বন্ধু ছিল না। তাই রীতিমত দুর্বল এবং পাতলাগোছের একটা ছেলে(নদীর ঘাটে বেড়াতে গেলে ভাবতাম ছেলেটা বাতাসে উড়ে না যায়) যে কিনা ব্যক্তিউদ্যোগে একটা বাচ্চাদের ম্যাগাজিন বের করে থাকে তার সাথে আমার ভারি বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। শহরে বেশি রাত হয়ে গেলে আমার শহরতলিতে না ফিরে ওর ব্যাচেলর বাসাতেই রাত কাটাতাম। তখন আমি গরীবের গরীব, ও সেদ্ধছাড়া কোনোকিছু রান্না করতে পারে না। আমি শুধু সেদ্ধ খেতে পারি না। সম্ভব হলে দুজনে বাইরে খেতাম, নাহলে সেদ্ধ খেয়ে নিতাম কোনোরকমে। বিবিধরকমের উদ্ভট বুদ্ধি আসত আমাদের দেশ ও জাতির রক্ষাকল্পে। একবার তো আইডিয়া এলো আমরা যুক্তি-তর্কে শান দেওয়ার একটা ক্লাব খুলবো (গ্রীসের সোফিস্টদের কায়দায়)। তিন ঘন্টা ভেবে নাম দাঁড়ালো নর্থোডক্স (No এবং Orthodox এর সন্ধি)। আমাদের নামটা খুব পছন্দ হলো কিন্তু সকাল হওয়ার পর আমাদের আর সেই উদ্যম থাকলো না। এমন এক একটা রাতে আমরা বহুবিধ আইডিয়ার জন্ম দিয়েছি এবং ভুলে গেছি। বস্তুতঃ আমরা ড্রীমার, আমাদের স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগত। দুজনেই লিখতাম, স্বপ্নবাস্তবতা নিয়ে ওর প্রচণ্ডরকমের আগ্রহ ছিল, পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতো খুব। অনেকগুলো ভালো লাগেনি, অনেকগুলো তাক লাগিয়েছে। ও চাইত মানুষ ওকে চিনুক, কিন্তু তার জন্য তৈলমর্দনে কখনোই প্রস্তুত ছিল না।

পেটরোগা ছেলেটা কখনোই বেশি খেতে পারত না। ওর ধাঁচটাই ওই। তবে ওর একটা প্রিয় খাবার ছিল রসগোল্লার রসে চুবিয়ে ডালপুরি খাওয়া। এমন খাবার-দাবার আমি এড়িয়ে চলি, তবুও চেখে ভালো লেগে গেলো। রোমেল ও রতনদার সাথে আমি আর আশরাফুল অনেকদিন এমন রসগোল্লার সাথে পুরি খেয়েছি। ওর মৃত্যুর পর অনেকদিন আমরা খেতে পারিনি অমন করে, আমি এখনও খাইনা, অন্যদের কথা বলতে পারি না।

ছেলেটা পড়তে গেলো ড্যাফোডিলের সাভার ক্যাম্পাসে। ক্যাম্পাসটা অত্যন্ত সুন্দর। তৈরী হলো কিছু নেশাদ্রব্যে আসক্তি। আসক্ত সে, বখাটে নয়। তবুও আসক্তিটা আমার ভালো লাগেনি যখন ড্যাফোডিলে গিয়ে দিনকয়েক ওর কাছে ছিলাম। বলতে গেলে আমি বেজায় রেগে ছিলাম। একআধটু গাঁজা খেতেই পারে তা বলে দিনরাত? মায়াবতী কিন্তু যথেষ্ট সৎ নয় এমন একজন প্রেমিকাও ছিল ওর। হ্যাঁ, প্রেমিকাই ছিল, আশরাফুলকে ভালোবাসত মেয়েটা।

আশরাফুলকে মেরে ওদের কী লাভ হয়েছে আমি জানিনা। ও কোথাও ওর দর্শন প্রচার করত না। ব্লগের জগতে ওর লেখালেখির সবটাই নির্ভেজাল সাহিত্য। তাও সঙ্খ্যায় অত্যন্ত কম। এমন একজন মানুষকে মেরে লাভটা কী তাও বুঝি না আমি। অভিজিৎ রায়কে হত্যা করে ওরা তাক লাগিয়ে দিয়েছিল, এমন করেছে আরো অনেককে মেরে। ‘আশরাফুলের মৃত্যু’ লিখে গুগল করলে প্রথমে একটাই সার্চ রেজাল্ট আসে প্রাসঙ্গিক। ও বিখ্যাত কেউ হয়ে ওঠেনি। কোথাও অভিজিৎ রায়, নিলয় নীলের নামের সাথে প্রগতিশীল বীরদের সাথে তার নাম আসে না। লিখত, নিজের মত থাকত মানুষটা। গল্প, বন্ধু, আঁকাআঁকি, ফিল্ম বানানোর স্বপ্ন এসবে দিনগুলো কাটছিল তার। যখন ওকে হত্যা করা হয়, ওর বন্ধুরা ওকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেয়। অতটুকু সময় প্রাণধারণের মত প্রাণশক্তিও ছিল না দুর্বল ছেলেটার। আমি বুঝতে পারলাম মৃত্যুর (এবং জীবনেরও) পিছনে কোনো কারণ থাকা জরুরি না। বয়স হয়ে বার্ধক্যজনিত কারণে না, রোগে ভুগে না, কোনো কারণ ছাড়া কোনো অর্থ ছাড়াই একজন মানুষকে খুন করা যায়। পৃথিবীতে যতদিন ‘আমি এবং শুধুমাত্র আমিই ঠিক’-রকমের দর্শন(?) থাকবে এমন চলতে থাকবে। আর এমন চলতে থাকবে বহুকাল যখন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে ১৮ কোটি নির্বোধ ঘনীভূত হয়।

তখন ছোট ছিলাম, একবছর পর লিখেছিলাম একটা কবিতা ওকে নিয়ে। সেখানে বলেছিলাম হতাশার কথা, এখন সেই হতাশা বহুগুণ হয়ে এদেশকে আচ্ছন্ন করেছে। দেশের নামে, ধর্মের নামে উগ্র-জাতীয়তাবাদ কি পাহাড়ে কি সমতলে দুর্বলের পরে প্রবলতর অন্ধকার হয়ে নেমেছে। এইসব মৃত্যু তার শুরুমাত্র ছিল, এইসব নিষ্প্রয়োজন মৃত্যু।