অপলাপ ০৪: কৈফিয়ত
বয়স চব্বিশ হলো মাসখানেক আগে। চব্বিশ আত্মজীবনী লেখার বয়স নয়। স্থিতধী মানুষের প্রজ্ঞার পরিচয় দেওয়ার বয়স নয় চব্বিশ। চব্বিশ উচ্ছলতার বয়স, ভুলের বয়স, কাম, প্রেম, মোহের বয়স। নির্বাণের বয়স নয়। কোনো ‘মহাজাগতিক সত্য’ জেনে স্থির হওয়ার বয়স নয়, সত্য আবিষ্কারের বয়স।
চব্বিশকে ধারণ করতে আমার বেগ পেতে হয়েছে। আমি এখনো তার সমস্ত গতি ও ঔদার্য গ্রহণ করতে পারিনি। যৌবনের শক্তি অপরিমেয়, গুঁড়িয়ে দেয়, ভেঙে দেয় সবকিছু, ভেতরটা টগবগ করে ফুটতে থাকে। আমি ক্লান্ত বোধ করছি।
বস্তুত, আমি খুবই ভাগ্যবান একজন মানুষ। বহুতর মানুষের অনাকাঙ্খিত ভালোবাসা আর শুভকামনায় আমি সিক্ত। সবাই এতটা পায়না, পায়নি অনেকেই।
আমি অনন্য (Exclusive), কিন্তু আমার এই অনন্যতা অনন্য নয়। প্রতিটা মানুষই অনন্য। ভালোভাবে বেঁচে থাকতে অনন্যতা কোনো শর্ত নয়, শুধু বলতে চাচ্ছি, অনন্য বড্ড এলেবেলে ব্যাপার। যুদ্ধে-ধ্বংসে বহু অনন্য মানুষ বেঁচে থেকেছেন, মারা গেছেন ততোধিক।
আমার কোনো উদ্দেশ্য নাই, মহৎ বা সাধারণ কিচ্ছু না, কোনোকিছুরই থাকতে পারে বলে মনে হয় না আমার। আমার চেতনা সত্যি যতক্ষণ আমি আছি। বেঁচে থাকাটার বিশেষ কোনো মানে নাই, মহাবিশ্বের কোনো মানে নাই, মানে থাকার প্রয়োজনও নাই।
বেঁচে থাকা সহজ, আমার মত এলেবেলে মানুষদের জন্য আরো সহজ। শ্বাস নাও, খাও, ব্যস! এত সাধারণ একটা প্রক্রিয়া যে করতে বেগ পেতে হয় না, ছেড়ে দিতেও না। কোডিঙ করি, লিখি। তার বাইরে আমি কান পেতে রই, একদিন মহাবিশ্ব হয়ত আমাদের সাথে কথা বলবে, তার ভাষায়। ভাষাটা গণিতও হতে পারে, সুরও হতে পারে। আমি যেকোনো সময় খুব সাধারণভাবে মরে যেতে পারি কিন্তু মরছি না, বা খুব আস্তে আস্তে মরছি ব্যাপারটায় একরকম মজা আছে। একথা অনস্বীকার্য যে আমি মৃত্যুমুখি (Pro-death individual)। বেঁচে থাকি অভ্যাসবশত, খুব সাধারণ একটা মৃত্যুতে আমার একটুও আপত্তি নাই। বেঁচে থাকার নিরন্তর কোনো প্রচেষ্টা আমার নেই, ছিলোও না কোনোদিন। আমি খুব অকপটে মরতে চেয়েছি।
চব্বিশ এগুলো বলার সময় না, চব্বিশ পৃথিবীটা ছিঁড়েখুঁড়ে অধিকার করার বয়স। কিন্তু আমি এমনই, অকৃতজ্ঞ। অথবা, সত্যিই কি অকৃতজ্ঞ? আমরা দাসখত লিখে জন্মাইনা। সমাজ, রাষ্ট্র কোনোকিছুই কি আমার জীবনের ওপর আমার চেয়ে বেশি অধিকার রাখে? বেঁচে থাকার পক্ষে আমার একমাত্র যুক্তি হচ্ছে, এর সৌন্দর্য অপার। ‘স্ট্যারি নাইট’-এর রঙের সমন্বয়ে, উপমহাদেশীয় সঙ্গীতের মীড়ে, একটা ভালো কবিতায়, লার্জ হ্যাড্রন কলাইডরের ভেতর হঠাৎ কোনো আবিষ্কারে প্রচণ্ড আনন্দ আছে, সৌন্দর্য আছে। আনন্দ ছাড়া আর কিছুই বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য না বেঁচে থাকার কারণ হিসেবে। এগুলোর মধ্যে ক্রমাগত শ্বাস নিতে নিতে মরে যাওয়া যায়। চব্বিশ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে আমার জীবনের (ও মৃত্যুর) কৈফিয়ত এটাই, এই মুহূর্ত মুহূর্ত ক্ষয়ে যাওয়া।
‘অপলাপ’ সংকলনের লেখামাত্রই অপলাপ নয়। জ্ঞানত অপলাপে আমার রুচি নেই। শুধু এই কথাটাই বলতে চাই যে আমার সত্য স্বাভাবিকভাবেই আমার দেখার রঙে রাঙানো। তা আমার কাছে যৌক্তিক। সে সত্য সার্বজনীন সত্যের মাপকাঠিতে মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে। এ তো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নয়, এ হলো আমার স্মৃতি যা সবসময়ই দুর্বল। সে দুর্বলতার ফাঁকগুলো আবেগের রঙ দিয়ে নিজের অজ্ঞাতেই পূরণ করতে পারি।