কবি

রফিক লিখতে বসলেন। তিনি বড় কবি হবেন একদিন। জীবনানন্দের মত বড় কবি।

লিখতে বসাটা সহজ না। তাকে লেপের ভেতর থেকে, মশারির কোনাটা একটু তুলে আস্তে আস্তে বের হতে হয় অন্ধকারে। আজকাল চোখেও ভালো দেখেন না। টেবিলের পরে হাতড়ে চশমাটা খুঁজে নিতে হয়। তারপর টেবিলল্যাম্পটা জ্বালান। সে এক রোমহর্ষক ব্যাপার। স্ত্রীর বয়স পঞ্চাশ ছুঁয়েছে, পাতলা ঘুম। সেটা ভাঙবে কি ভাঙবে না এ নিয়ে বেশ শঙ্কা রফিকের। তার বয়সও কম না। মিঠে গঞ্জনাও একঘেয়ে লাগে আজকাল।

আবছা আলোয় লিখতে রুলটানা খাতাই ভালো, লাইনগুলো বেঁকেচুরে যায় না। কলম, কারেকশন মার্কার, ড্রয়ারে কয়েকটা ছোট ছোট প্যাকেটে বিস্কিট, এক বোতল পানি। বাইরে চাঁদ আছে, শীতের জন্য জানলাটা খোলা গেলো না। তার হাত নিশপিশ করে লিখতে, তিনি লিখতে শুরু করেন। বস্তুত গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে তিনি প্রায় একইভাবে লিখছেন। সকালে, রাতে, বিকেলে। ভাত খেয়ে বা না খেয়ে। এমনকি অফিসেও। রামপ্রসাদরা যুগে যুগে আসেন। প্রথম জীবনে দ্রুত সঙ্গম শেষ করেছেন কবিতার তাগিদে- এমনও হয়েছে, খুব বেশি নয় অবশ্য। মোটের ওপর কবিতা তার নেশা নয় বরং মৌলিক চাহিদা। রোজই দু-তিনটে লেখেন। লিখতে লিখতে মাঝরাত গড়িয়ে শেষরাতে পৌঁছয়, স্ত্রীর মৃদু ঘুম মৃদুতর হওয়ার সময় তখন। তিনি বিছানায় যান। এমন পাগল মানুষদের মগজে একটু বাস্তববুদ্ধি ঢালার লোকের অভাব হয় না এবং তার স্ত্রীও তাদের বাইরে নন। কিন্তু, পাশে থাকার মানুষের বেশ অভাব, বিশেষত, মাঝরাতে ঘুমের ভেতরেও আঁকড়ে ধরারও। সেই দলেও তার স্ত্রী।

ব্যাপারটা ভালো হলো না। রফিক কাঁপছেন থরথর করে। সন্ধ্যাটা তিনি একটা আড্ডায় থাকেন। তারচেয়ে কম বা বেশি মাত্রায় পাগল, উজ্জ্বলতম নক্ষত্র থেকে ঢিমে উপগ্রহ সবরকম লেখকদের একটা আড্ডায়। তিনি রোজ কিছু না কিছু পড়েন, কেনই বা পড়বেন না? তিনি তো রোজই লিখছেন! অন্যদের কবিতাও শোনেন, সবটা ভালো লাগেনা, যেটুকু ভালো লাগে, সেটুকুতে ঈর্ষাও হয়। তবু শোনেন। তার কবিতাও সবাই শুনে যায়, কেউ কিছুই বলেন না। বোধহয়, পছন্দ হয়না কারো। ভদ্রতার খাতিরে তারা হয়ত মনযোগ রাখতে চেষ্টা করে। যারা তরুণ, তারা পড়ার মাঝখানে সিগারেট খেতে বেরিয়ে যায়। রফিকের অস্বস্তি হয় সব মিলে। অনেকদিন ধরেই।

আজ এক তরুণ তার কবিতা নিয়ে কথা বলেছে। যা বলেছে ভদ্রভাবে বললে অর্থটা দাঁড়ায়, “আপনার কবিতাই হয় না।” তবু কথাটা এত শালীনতায় বোনা ছিল না। আর স্বরেও উগ্রতা ছিল। ব্যক্তিআক্রমণই বলা চলে। রফিক ভেবেছিলেন, অন্ততঃ উগ্রতার কেউ প্রতিবাদ করবে। কিন্তু একেকটা মানুষ থাকে অকারণেই যাদের সবাই প্রথম দেখাতেই অপছন্দ করে ফেলেন। রফিকও বোধকরি সেই জাতেরই। তাই ট্রাম্প পড়লো না কোথাও, রফিক নিজে চিড়িতনের দুইকরার মত বুক চিতিয়ে এগোলেন। কর্তাব্যক্তিরা সময়মত না থামালে কথা কাটাকাটি হয়ত হাতাহাতির পর্যায়ে যেত। সবাই ঠেলে দুজনকে দুই কোনায় রাখল আলাদা করে। যখন তিনি আড্ডা থেকে কয়েক পা এগিয়ে রিকশা নিলেন তখন তার সোয়েটার পর্যন্ত ঘাম, হাঁপাচ্ছেন, কাঁপছেন। চোখে জল ছিল কিনা, পাঠক, আপনাকে তা কল্পনার পূর্ণ স্বাধীনতা দিচ্ছি।

রফিক ওয়াশরুমে অনেকক্ষণ ধরে। বেসিনে মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছেন ক্রমাগত। অপমানটা ধুয়ে ফেলার চেষ্টা। ঝাপটায় হাতের পুনরাবৃত্তিতে কাঁপুনিটা আস্তে আস্তে কমে আসছে। তিনি টেবিলে বসলেন। ঘরে ঢুকলেন তার স্ত্রী, হাতে এক কাপ চা। কাজের মেয়ের চা রফিক মুখে দিতে পারেন না, অবশ্য প্রতিবাদও করেন না কখনো। শুধু কাপে চা পড়ে থাকে। তাই চা-টা তিনি নিজেই বানিয়ে আনেন। চা রাখা হলো টেবিলে, কেউ ছুঁলো না। রফিকের স্ত্রী বললেন, “কী হলো? চা বাদেই কবিতা লেখা হবে এখন?”
রফিক কিছু বললেন না।
- শরীর খারাপ?
- আমার নাকি কবিতা হয় না! আরে তুই বলার কে? তোকে কে বলতে বলেছে? কতটুকু জানিস তুই? আমার হাঁটুর বয়স তোর! বললেই হলো হয় না? আমি কি এতদিন ধরে ছিঁড়ছি? তুই একদিনেই বলে দিবি কিচ্ছু হয় না?…

মানুষ বার্ধক্যে নুয়ে ক্রমে শৈশবে পৌঁছয়। শিশুর মত অভিমানে রফিক অনর্গল বকলেন। এগুলোর কিছুই আড্ডায় তিনি বলতে পারেন নি। কাগজপত্র ফেললেন এদিক-ওদিক ছুঁড়ে।

- কিচ্ছু হয়নি! আরে সবাই কি জীবননান্দের মত বড় হয়? তাই বলে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর ধরে কিচ্ছু করিনি আমি! বলে কি এরা! কত বড় সাহস।

একটু যখন শান্ত রফিক, আবিষ্কার করলেন, তিনি মুখ গুঁজে পড়ে আছেন তার স্ত্রীর বুকে। বাচ্চাদের মত ঠোঁট ফুলিয়ে বললেন,

- তুমিও কি তাই মনে করো? কিচ্ছু হয়নি?
- আমি কি বুঝি এত? প্রথম প্রথম যখন পড়ে শোনাতে, দেখে মনে হত বেশ মজা হচ্ছে তোমার। আমার তাতেই ভাল্লাগতো।

রফিক একটু হাসলেন, চেয়ে দেখলেন, ঘরময় কাগজপত্র ছড়ানো-ছিটনো। তার স্ত্রী বললেন,

- আমি গুছিয়ে দেবো, তুমি রাতে লিখতে বসো আবার।
- আমি তো আর লিখবো না।
- ধুর! কে কী বললো তাতে একেবারে…
- তা না, সত্যিই তো।
- কী?
- আর লেখার দরকার নেই।

তিনি মোটামুটি ভালোই থাকেন আজকাল। লেখালেখি বাদ দিয়ে অখণ্ড অবসর পেয়েছেন। সকালে পাখিদের মুড়ি খাওয়ান, বিকেলে হেঁটে আসেন একটু। মোটের ওপর পাগলামিগুলো জীবন থেকে বাদ দিলে যে বেশ শান্তিতে থাকা যায় তিনি নিজেই তা বেশ বুঝতে পারছেন। রাতজাগা অভ্যাসটা এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। বারান্দার চেয়ারটাতে বসে থাকেন। উঠোনের গাছেদের ছায়া কোনো কোনোদিন চাঁদের আলোয় নিজেদের চিনিয়ে দেয় নয়ত অমাবশ্যার আঁধারে মিশে থাকে, সঙ্গোপনে। তিনি দেখেন বসে বসে। জীবনানন্দ আওড়ান। জীবনব্যাপী ছাপোষা একজন মানুষ, কামে, প্রেমে বা অন্নসংস্থানে যার কখনো বিফলতা আসেনি বিষাদ ব্যাপারটাই তার কাছে আনকোরা। তিনি তার বিষাদের উপযুক্ত কবিতা পান না, আর লেখেনও না। মনে মনে পদ আওড়ে যান, লিখতে সাহস হয় না।

যে সব নক্ষত্র আত্মমগ্ন পুড়ে হলো ছাই
আলোকবর্ষ দূরে
তার সুগভীর ব্যথা, প্রজ্ঞা নিবিড়
আমার হৃদয়ে কই?
তাই আর কবিতা লিখিনা
আমার কবিতা নেই।